কয়লার ভেতর পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের গচ্চা
>
- বড়পুকুরিয়ার কয়লাখনি
- ১৩ বছরে প্রথম আর্দ্রতা পরীক্ষা বলছে, কয়লায় পানি অনেক
- বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দ্বিগুণ হারে পানিতে ছাড় দিয়েছে
দিনাজপুরে সরকারের বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র এতকাল কয়লা কেনার সময় কখনো সেটার আর্দ্রতা মাপেনি। বিতর্কের মুখে তিন মাসের এক হিসাব দিয়ে তারা বলছে, এ সময় আদতে কেন্দ্রটি কয়লার দরে প্রায় ১৫ হাজার টন পানি কিনে লোকসান গুনেছে।
তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লা কিনেছে সরকারেরই বড়পুকুরিয়া কয়লা কোম্পানির কাছ থেকে। হিসাবটি বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে কয়লার আর্দ্রতা ছিল ১৭ শতাংশ।
লোকসান হিসাব করতে গিয়ে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লায় সম্পৃক্ত পানির গ্রহণযোগ্য মাত্রা ধরেছিল ১০ শতাংশ। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি বলেছে এখন থেকে আর্দ্রতার গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫ শতাংশে নামাতে। সেভাবে হিসাব করলে তিন মাসের লোকসান আরও বাড়বে। ১০ শতাংশ আর্দ্রতা গ্রহণযোগ্য ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত পানির পরিমাণ দেখিয়েছে ১৪ হাজার ৫৫৮ টন। কয়লার পরিশোধিত দর অনুযায়ী তাতে ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়ায় ১৫ কোটি টাকার মতো। তবে আর্দ্রতার নতুন নির্ধারিত মাপকাঠি অনুযায়ী অতিরিক্ত পানি হবে ২৪ হাজার টনের মতো। এর দাম ২৫ কোটি টাকা ছাড়াবে।
তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে যায় ২০০৫ সালে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম মনে করেন, কয়লায় আর্দ্রতার ধারা গত ১৩ বছরে একই রকম ছিল। সেই হিসাবে এযাবৎ পানিতে যাওয়া লোকসানের পরিমাণ হবে বিপুল।
বড়পুকুরিয়ায় কয়লার আর্দ্রতা না মাপার বিষয়টি অনেক পুরোনো এবং দুই স্তরের। খনি থেকে কয়লা তোলে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, সংক্ষিপ্ত নামে সিএমসি। সিএমসির কাছ থেকে কয়লা কিনে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে বিক্রি করে বড়পুকুরিয়া কোল কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল)।
খনির কয়লায় কমবেশি পানি থাকে। সিএমসির সঙ্গে কয়লা কোম্পানির চুক্তিতে এর গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫ দশমিক ১ শতাংশ। কয়লায় এর বেশি আর্দ্রতা থাকলে, হিসাবে সেটার দাম ধরা হবে না। কয়লা কোম্পানি আর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের আধুনিক গবেষণাগার আছে, তবে ২০০৫ সাল থেকে এযাবৎ কেউই কয়লার আর্দ্রতা মাপেনি।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে কয়লার অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন প্রায় দেড় লাখ টন কয়লার হিসাব মিলছিল না। কয়লা কোম্পানি নিজেদের ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘কয়লা চুরি’র মামলা করে। ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো এ নিয়ে একটি প্রতিবেদনে অতিরিক্ত আর্দ্রতা এবং আর্দ্রতা না মাপার বিষয়গুলো বিস্তারিত তুলে ধরে।
এরপর ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি তাদের কেনা কয়লার আর্দ্রতা মাপা শুরু করে। নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসের লাভ-লোকসানের যে হিসাব তারা করেছে, তাতে দেখা যায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১০ শতাংশ আর্দ্রতাকে গ্রহণযোগ্য ধরে বিল চুকিয়েছে।
গত ৪ মার্চ বিদ্যুৎ বিভাগে ‘বিসিএমসিএল থেকে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহকৃত কয়লায় মাত্রাতিরিক্ত আর্দ্রতার বিল সমন্বয়’ শীর্ষক একটি বৈঠক হয়। জ্যেষ্ঠ বিদ্যুৎসচিব আহমেদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে বলা হয়, গত বছর তিন মাসে কয়লায় আর্দ্রতা পাওয়া গেছে গড়ে ১৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এটা অনেক বেশি। এ ছাড়া কয়লার সঙ্গে পাথর ও লোহাজাতীয় পদার্থ থাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষতি হচ্ছে।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এখন থেকে উত্তোলনকারী ঠিকাদার, কয়লা কোম্পানি ও বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ একযোগে উপস্থিত থেকে খনি প্রান্তের ওজনযন্ত্রে কয়লা মাপবে। দিনে কমপক্ষে দুবার আর্দ্রতা মাপা হবে। আর্দ্রতা ৫ দশমিক ১ শতাংশের বেশি হলে কয়লার দাম থেকে তা কাটা যাবে। পাথর-লোহার ওজনও সমন্বয় করা হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ ১ এপ্রিল থেকে সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র আগে কেন ১০ শতাংশ আর্দ্রতাকে গ্রহণযোগ্য বলেছিল, এটি পরিষ্কার নয়। ফলে গোটা বিষয়টি নিয়ে নিবিড় তদন্ত হওয়া উচিত।
তবে বেশি আর্দ্রতায় কয়লা কেনার বিষয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্তৃপক্ষকে দুষছে কয়লা কোম্পানি। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের উচিত ছিল কয়লার আর্দ্রতা পরীক্ষা করে নেওয়া। এখন তারা বলছে আর্দ্রতা বেশি। এটি গ্রহণযোগ্য নয়।
অধ্যাপক এম শামসুল আলম অবশ্য বলছেন, এ যুক্তি ধোপে টেকে না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যত সময় যাবে কয়লার আর্দ্রতা কমতে থাকবে। বাড়ার কোনো সুযোগ নেই, যদি না কয়লা বৃষ্টিতে ভেজে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের হিসাবভুক্ত তিন মাসে বৃষ্টি ছিল না।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, সেই ২০০৫ সাল থেকেই বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে অত্যাধুনিক ল্যাব, যন্ত্রপাতি আছে। রসায়নবিদও আছেন। অথচ আর্দ্রতার হিসাব রাখা শুরু হলো গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে।
এত দিন হয়নি কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান রসায়নবিদ মো. আজাদ সোহেল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না।’ আর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যুক্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২০১৭ সালে ‘কয়লা চুরি’ তথা কয়লার ময়লা আলোচনায় এলে সরকারি-বেসরকারি চারটি তদন্ত কমিটি হয়। এর মধ্যে শুধু খনির তদারকি সংস্থা পেট্রোবাংলা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনটি বলেছে, খনি কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই কয়লার যথাযথ হিসাব রাখেনি। এর দায় সংস্থাটির তৎকালীন সব দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ওপর বর্তায়।
পেট্রোবাংলা ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালককে (প্রশাসন) প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়। আরেকটি তদন্ত কমিটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে একটি কমিটি করে।
অধ্যাপক শামসুল আলম ক্যাবের তদন্ত কমিটির সদস্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কয়লাতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে হরেদরে ১২ শতাংশ বেশি পানি থাকার বিষয়টি এখন প্রমাণিত। কিন্তু কয়লায় বাড়তি পানি কারা দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে কারা জড়িত, ক্যাব সেটাই তদন্ত করছে। কাজ শেষ পর্যায়ে।