করোনায় করুণ হাল নার্সারিগুলোর

ক্রেতা নেই। তবুও অযত্নে তো ফেলে রাখা যায় না নার্সারিকে। তাই চলছে পরিচর্যা। রাজধানীর সবুজ বাংলা নার্সারি থেকে আজ তোলা। ছবি: তানভীর আহম্মেদ
ক্রেতা নেই। তবুও অযত্নে তো ফেলে রাখা যায় না নার্সারিকে। তাই চলছে পরিচর্যা। রাজধানীর সবুজ বাংলা নার্সারি থেকে আজ তোলা। ছবি: তানভীর আহম্মেদ

চারপাশে ফুলেফলে সাজানো বাগানের মতো অনেক ছোটবড় গাছের সমাবেশ। তার মধ্যে বসে হিসাবের খাতায় লিখছিলেন গ্রিন ওয়ার্ল্ড নার্সারির মালিক সোহরাব হাসান। বেচাকেনার কথা জিজ্ঞাসা করলে বললেন, ঢাকায় গাছপালা কেনেন শৌখিন লোকজন, যাঁদের বাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে। করোনার আশঙ্কায় তাঁরা বাইরেই বের হন না। গাছপালা কেনার লোক কোথায়!

শনিবার দুপুরে কথা হচ্ছিল আগারগাঁও চৌরাস্তা মোড়ের এই নার্সারির মালিকের সঙ্গে। শেরেবাংলা নগরে ২০-২৫টির মতো নার্সারি গড়ে উঠছে। এখানে বড় নার্সারিগুলোর মধ্যে রয়েছে—সবুজ বাংলা নার্সারি, কৃষিবিদ উপকরণ নার্সারি, বরিশাল নার্সারি, বিএফএ শাহিন নার্সারি, গ্রিন ওয়ার্ল্ড, হর্টাস, জান্নাত নার্সারি। এর মধ্যে কৃষিবিদের ব্যবস্থাপক সোহানুর রহমান, জান্নাতের মালিক খন্দকার শরিফুল আলম, গ্রিন ওয়ার্ল্ডের মালিক সোহরাব হোনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাধারণত প্রতিবছর ৫ জুন থেকে জাতীয় বৃক্ষমেলা শুরু হয়। এ বছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে তা হয়নি। বৃক্ষমেলা সামনে রেখে তাঁরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। বন বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে মেলা হবে না, এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেই। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান চলে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে জুলাই বা আগস্টেও বৃক্ষমেলা হতে পারে। তবে আগামী দুমাসে করোনার সংক্রমণ কমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে, এমন লক্ষণ দেখছেন না নার্সারির মালিকেরা। তাই তাঁরা ধরেই নিয়েছেন এ বছর আর বৃক্ষমেলা হচ্ছে না। এদিকে স্বাভাবিক বিক্রিও প্রায় ৭০ ভাগ কমে গেছে। অনেক ক্ষতি হচ্ছে তাঁদের। 


শনিবার দুপুরে সবুজ বাংলা নার্সারিতে দেখা গেল ড্রামে লাগানো সারি সারি আমগাছের সরু শাখাগুলো নুয়ে আছে আমের থোকায়। পেকে রাঙা হয়ে আছে কিছু কিছু। পাশেই করমচাগাছ ভরে আছে অজস্র গোলাপি ফলে। আমলকী, বাতাবিলেবু, জামরুল, লটকন—সব গাছেই ফলের সমাহার। এখন ফলেরই মৌসুম চলছে। বরাবর এসব ফল-ফুলের গাছের বিপুল মনোরম সমারোহ ঘটে জাতীয় বৃক্ষমেলায়। করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের ফলে এবার এখনো বৃক্ষমেলা শুরু হয়নি। এসব গাছগাছালি এখন নার্সারিতেই শোভা পাচ্ছে । তবে বেচাকেনা একেবারে বন্ধ হয়নি।

কিছু ক্রেতা নার্সারি থেকে গাছ ও চারা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। সবুজ বাংলা নার্সারির ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হোসেন জানালেন, গত বৃক্ষমেলায় তাঁরা ৫০ লাখ টাকার বেশি বিক্রি করেছিলেন। মেলার পরও তাঁদের এখানে বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার টাকার নানা জাতের চারা ও বড় গাছ বিক্রি হতো। এবার মেলা তো হয়নি, উপরন্তু প্রতিদিনের বিক্রিও তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।

কিছু ফলের চারা কিনতে শনিবার দুপুরে এখানে এসেছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন। তিনি একটু বড় আকারের হাইব্রিড লেবু ও আমের গাছ কিনেছেন। মতিঝিলে সরকারি আবাসনে থাকেন। সেখানে ভবনের সামনে এবং ছাদে বাগান করছেন। সেখানে এসব গাছ লাগাবেন। বরাবর বৃক্ষমেলা থেকেই চারা কেনেন। এবার মেলা হচ্ছে না, তাই সরাসরি নার্সারিতেই এসেছেন বলে জানালেন।
নার্সারির মালিকেরা জানালেন, শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়েও জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত বৃক্ষমেলা হয়ে থাকে। অনেক মানুষ কেবল বেড়ানোর জন্যও মেলায় আসেন। ফলভরা গাছের শোভা, ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁরা কিনে নেন। এভাবেই মানুষের মধ্যে বৃক্ষরোপণের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। করোনার সংক্রমণের জন্য এবার মেলা না হলে সেই আগ্রহের ধারাবাহিকতায়ও ছেদ পড়বে। আর্থিক ক্ষতি ছাড়া এটাও একরকম বড় ক্ষতি।

ছোট আমগাছে ধরেছে অনেক আম। এমন গাছ দ্রুত বিক্রি হয়ে যেত অন্য সময়। কিন্তু করোনার কালে বিক্রি নেই। ছবি: তানভীর আহম্মেদ
ছোট আমগাছে ধরেছে অনেক আম। এমন গাছ দ্রুত বিক্রি হয়ে যেত অন্য সময়। কিন্তু করোনার কালে বিক্রি নেই। ছবি: তানভীর আহম্মেদ

এ প্রসঙ্গে কথা হলো নার্সারির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নার্সারি মেন সোসাইটির সভাপতি সাভারের রাঙ্গাবন নার্সারির মালিক মেসবাহ উদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক বরিশাল নার্সারির মালিক মোহাম্মদ ইব্রাহীমের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, বৃক্ষমেলা না হওয়াটা তাঁদের জন্য অনেক বড় ক্ষতি। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ১১০টির মতো নার্সারি জাতীয় বৃক্ষমেলায় অংশ নেয়। গত বছর মেলায় ১ কোটির বেশি চারা ও গাছ বিক্রি হয়েছিল। টাকার অঙ্কে এখন প্রতি মেলায় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা বিক্রি হয়। মেলা না হলে এর পুরোটাই ক্ষতি। আর এবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মেলার প্রস্তুতিও বড় ছিল। অনেকে অনেক দুর্লভ গাছ ও চারা আমদানি করেছেন। নিজেরাও অনেক রকম চারা উত্তোলন করেছেন। ফলে নার্সারির মালিকেরা বেশ বিপদে আছেন।

নার্সারির মালিকদের এই নেতারা জানালেন, বছরে চারা বিক্রির দুটো মৌসুম। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত শীতকালে ‘ফুলের মৌসুম’। আর জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত বর্ষায় ‘ফলের মৌসুম’। ফলের মৌসুমেই বিক্রি বেশি হয়। গাছে ফল ধরা থাকে। মেলায় এসব গাছ ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁরা জানালেন, সারা দেশে তাঁদের সমিতিভুক্ত নার্সারি ৫ হাজার। তবে সব মিলিয়ে দেশে বাণিজ্যিক নার্সারি প্রায় ২০ হাজার। ঢাকা ও আশপাশে সাভার, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে প্রায় ৩৫০টি নার্সারি রয়েছে। মেলায় তো এক কোটি চারা বিক্রি হয়, এ ছাড়া মেলার পরে জুলাই-আগস্ট এই দুই মাসে এসব নার্সারিতে আরও প্রায় এক কোটি চারা বিক্রি হয়। এখন যে পরিমাণে বিক্রি হচ্ছে তাতে এবার ফলের মৌসুমে মোট ৩০ থেকে ৪০ লাখ চারা বিক্রি হতে পারে।

নার্সারিতে থেমে নেই পরিচর্যা। ছবি: তানভীর আহম্মেদ
নার্সারিতে থেমে নেই পরিচর্যা। ছবি: তানভীর আহম্মেদ

বৃক্ষমেলা প্রসঙ্গে জানতে বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানালেন, করোনার সংক্রমণের কারণে জুন মাসে মেলা করা যাচ্ছে না। তবে মেলার পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়নি। আগামী আগস্ট পর্যন্ত জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান চলবে। পরিস্থিতি ভালো হলে সুবিধামতো সময়ে মেলা করা যেতে পারে।