গত ২২ জুলাই প্রথম আলো অনলাইনে নাগরিক সংবাদে প্রকাশিত একটি লেখার শিরোনাম ছিল: ‘হারিয়েই কি যাবে সাতক্ষীরার গাবুরা ইউনিয়ন?’ স্মরণকালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলা (২০০৯) এবং অতিসম্প্রতি (২০২০ সালের ২১ মে) আম্পান-পরবর্তী সময়ে এ রকম আশঙ্কা শুধু গাবুরা ইউনিয়নের জন্য নয়, বরং শ্যামনগর, আশাশুনি, কয়রা, দাকোপসহ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এই জনপদ কি সত্যিই বিলীন হওয়ার পথে? কেন এ আশঙ্কা? এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় কী?
হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বহু পথ অতিক্রম করে বছরে ১০০ কোটি টনের বেশি পলি নিয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে মিশে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী সম্মিলিতভাবে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলি বহন করে। এই পলি পড়তে পড়তে জমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে উর্বর ভূমি। এ ভূখণ্ডই আমাদের বাংলাদেশ।
বদ্বীপের গতি-প্রকৃতি
ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, বঙ্গীয় বদ্বীপ এখনো অপরিণত এবং নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শুধু প্রাকৃতিক কারণেই কয়েক হাজার বছরে গঙ্গা ও পদ্মা গতিপথ পরিবর্তন করেছে। পশ্চিম থেকে পূর্বে সরে গেছে।
এর ফলে বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে পলি ও মিঠাপানির প্রবাহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বিপরীতে বাড়ছে লবণাক্ততা। জমিতে পলি জমার প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে এ বদ্বীপে কোথাও কোথাও ভূমির ক্ষয় বা বৃদ্ধি হচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে পুরো দেশের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ভূমিক্ষয়ের হার অনেক বেশি। পাশাপাশি ভূতাত্ত্বিক কারণে ভূমি নিমজ্জনের (বা ভূমি ডুবে যাওয়া) হারও এ অঞ্চলে বেশি (বছরে ৫.২ থেকে ৮.৮ মিলিমিটার)।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হারও এ অঞ্চলে অনেক বেশি—বছরে প্রায় ৪ মিলিমিটার। বিশ্বের অন্যান্য বদ্বীপের তুলনায় এ হার অনেক বেশি, যা দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলবাসীর জীবন-জীবিকার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
শুধু প্রকৃতি নয়, বাংলাদেশ বদ্বীপ নানা রকম আর্থসামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েও গেছে। ব্রিটিশ উপনিবেশ আমল থেকে এখানে নদীকে নানাভাবে শাসন করার চেষ্টা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, যা নদীর পলি ও মিঠাপানির প্রবাহ হ্রাসের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় দুটি বই থেকে। একটি হলো ১৯২৫ সালে প্রকাশিত তৎকালীন বেঙ্গল পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের পরিচালক ডা. বেন্টলির বাংলায় ম্যালারিয়া ও কৃষি। অন্যটি ১৯৩০ সালে প্রকাশিত স্যার উইলিয়াম উইলকক্সের বাংলায় প্রাচীন কৃষি পদ্ধতির ওপর দেওয়া বক্তৃতা সংকলন।
ওই বই দুটিতে বলা হয়েছে, উপনিবেশ সময়ে রেলপথ ও নদীভিত্তিক অবকাঠামো নির্মাণ, বিকল্প খাল খনন, সেচব্যবস্থা এই অঞ্চলের নদীর প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করেছে। ওই সময় থেকেই নতুন নতুন বিপর্যয়ের শুরু হয়।
এই প্রক্রিয়া পাকিস্তান শাসনামল হয়ে আমাদের স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশেও চলমান আছে। আমাদের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যে বেড়িবাঁধগুলো ষাটের দশকে নির্মিত হয়ে এখনো টিকে আছে, তা মূলত বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও দাতা সংস্থাগুলোর প্রস্তাবে নির্মিত হয়। পাকিস্তান আমলে শুরু ওই বেড়িবাঁধগুলো পরবর্তী সময়ে জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততার মতো বিপর্যয়কে আরও বাড়িয়েছে।
সুরক্ষা ছিল অষ্টমাসি বাঁধে
জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে অষ্টমাসি বাঁধ ব্যবস্থা চালু ছিল। বন পরিষ্কার করে বসতি ও জমির চারপাশে এসব বাঁধ দেওয়া হতো। যার উদ্দেশ্য ছিল জমি যাতে আবার বনভূমিতে পরিণত না হয়।
শুষ্ক মৌসুমে জমিতে লবণপানি প্রবেশ ঠেকানোও ছিল এমন বাঁধের বড় উদ্দেশ্য। কারণ, জমিতে লবণপানি প্রবেশ করলে সেখানে আবার সুন্দরবনের বৃক্ষরাজি জন্মাত। সেই ভয় থেকে পরিত্রাণের জন্য বছরে আট মাস টিকে থাকে এমন বাঁধ নির্মিত হতো। অষ্টমাসি বাঁধ নামে পরিচিত ওই অবকাঠামোগুলো এই অঞ্চলে কৃষির সুরক্ষায় কাজে দিত।
ভারতবর্ষ স্বাধীনতার পর জমিদারি প্রথার অবসান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অষ্টমাসি বাঁধ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটে। কেননা জমিদারদের কর্মচারীরা গ্রামের সাধারণ জনগণ ও কৃষকদের সংগঠিত করে ওই বাঁধগুলো নির্মাণ করতেন। ওই বাঁধ না থাকায় কৃষির উৎপাদন হ্রাস পায়।
পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪-৫৫ সালে উপকূলসহ সারা দেশে ব্যাপক বন্যা হয়। এ বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বব্যাংক ও নেদারল্যান্ডসের প্রকৌশলীদের পরামর্শে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে উপকূলজুড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি। বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রথম দিকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। মানুষের মধ্যে নিরাপত্তা বোধও তৈরি হয়। উপকূলে বাড়তে থাকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের ফলে কম ক্ষতিকর বন্যা বন্ধ হলেও মাঝেমধ্যে বড় বন্যা বন্ধ হলো না। অন্যদিকে বাঁধব্যবস্থা উপকূলীয় মানুষকে জোয়ার ও বন্যা থেকে নিরাপত্তার একটা মিথ্যা অবয়বও তৈরি করল। প্রথম দিকে এ থেকে উপকার পাওয়া গেলেও পরবর্তী সময়ে এর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব দৃশ্যমান হয় আশির দশকে, যখন যশোর-খুলনা অঞ্চলে জলাবদ্ধতা শুরু হয়।
দীর্ঘদিন পলি না জমায় কৃষিজমি অনুর্বর ও নিচু হতে থাকে, নদীর তলদেশে পলি জমতে থাকায় নদীর নাব্যতা হ্রাস পায় ও নদী মারা যায়। ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা স্থায়ী বন্যায় রূপ নেয় এবং পরিবেশ ও জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতি হয়।
আশির দশকে বাগদা চিংড়ি উৎপাদন শুরু হয় ব্যাপকভাবে। এ জন্য দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাঁধ কেটে লবণপানি ভেতরে ঢোকানো হয়। এ ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা উপকূলীয় এলাকায় এসে চিংড়ি চাষ বাড়াতে থাকেন। এর ফলে চিরসবুজ প্রকৃতি অল্প সময়ের মধ্যে লবণজলের প্রভাবে বৃক্ষহীন ধূসর প্রান্তরে পরিণত হয়।
এর সঙ্গে উপকূলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগও বেড়ে গেছে। কিন্তু প্রকৃতির এ পরিবর্তন আমলে না নিয়ে সেখানে একের পর এক বড় উন্নয়ন প্রকল্প ও অবকাঠামো নির্মাণ চলছে, যা দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের বড় অংশকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
এ অঞ্চলকে এই বিপদ থেকে বাঁচাতে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। প্রকৃতিকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের কারণে অনেক সভ্যতার যেমন পতন হয়েছে, তেমনি অনেক সভ্যতা টিকে আছে মূলত পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে।
অবাধ জোয়ারভাটাতেই সমাধান
উপকূলীয় এলাকাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার একমাত্র উপায়, বর্তমানে পরিবেশবিধ্বংসী উন্নয়ন ধারা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। বদ্বীপ গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। এর মধ্যে উপকূলের পলি ব্যবস্থাপনায় অবাধ জোয়ারভাটা (টিআরএম বা টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট নামে পরিচিত) অন্যতম।
এ পদ্ধতিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে বাঁধ কেটে দেওয়া হয়। এতে নদীর পানি নিচু বিল অঞ্চলে প্রবেশ করে। আর ভাটার টানে সে পানি আবার বেরিয়ে যায়। এতে জলাবদ্ধতা দূর হয়। নদীর নাব্যতাও বাড়ে। পুরো প্রক্রিয়াকে অবাধ জোয়ারভাটা বলা হয়।
সাম্প্রতিককালের কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, টিআরএম কৃষিজমিতে পলি জমিয়ে ভূমির উর্বরতা ও উচ্চতা বৃদ্ধি করছে। কিন্তু এটি প্রয়োগ করার জন্য প্রয়োজন ওই অঞ্চলে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে সমন্বয়।
এ ধরনের প্রকৃতিনির্ভর উপায় পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও কাজ করছে। যেমন নেদারল্যান্ডস শত শত বছর ধরে প্রযুক্তিনির্ভর বাঁধ ব্যবস্থাপনাকেই বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় হিসেবে প্রয়োগ করে এসেছে। তারা ১৯৯৩ ও ১৯৯৫ সালে বন্যার ব্যাপকতা ও ক্ষয়ক্ষতি উপলব্ধি করে প্রযুক্তিনির্ভর বাঁধ ব্যবস্থাপনা থেকে সরে এসেছে।
দেশটি বাঁধ অবমুক্ত করে বন্যার পানি নিচু বিল অঞ্চলে প্রবেশ করাচ্ছে। ঠিক একইভাবে বেলজিয়ামও নিচু অঞ্চলে নিয়ন্ত্রিত বন্যা ঘটিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে বন্যা ব্যবস্থাপনার দিকে মনোনিবেশ করছে।
স্থানীয় জ্ঞান কাজে লাগাতে হবে
উপকূলের দুর্যোগ ও বিপর্যয় মোকাবিলায় অনেক প্রকৃতিনির্ভর ও লোকায়ত প্রক্রিয়া আগে ছিল। কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গেছে, যা খুঁজে বের করাও দরকার। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর উপকূলীয় বাঁধ ব্যবস্থার পুনর্বাসনের দাবি উঠছে। এ জন্য দাতা সংস্থাগুলোও আগ্রহ প্রকাশ করছে।
তাই জনগণের বাঁধ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ বা পুনর্বাসনের দাবিগুলো শাব্দিক অর্থে না নিয়ে এর অন্তর্নিহিত কারণ, দাবির বিষয়বস্তু জানতে ও বুঝতে হবে। বুঝতে হবে জনগণের দাবি বাঁধ নির্মাণ নাকি দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা? দাবির শাব্দিক অর্থ হয়তো বাঁধ নির্মাণ, কিন্তু অন্তর্নিহিত দাবি হচ্ছে দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা।
আর তা-ই যদি হয়, তাহলে এর সমাধান শুধু বাঁধ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ বা পুনর্বাসনে নেই। প্রকৃতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাতেই এর সমাধান। সে জন্য বাঁধের পাশাপাশি টিআরএমের মতো প্রাকৃতিক উপায়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে আস্তে আস্তে প্রয়োগ করতে হবে। এই সমাধানকে এই অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়নের মূল পরিকল্পনায় আনতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
নিজেদের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে, বিদেশি পরামর্শের জন্য অপেক্ষা না করে, শুধু আধুনিক প্রকৌশলবিদ্যানির্ভর না হয়ে, দেশের নদী ও মাটি নিয়ে অন্য যে জ্ঞানের শাখাগুলো আছে, তাদেরও এ ব্যাপারে যুক্ত করতে হবে। ভূতত্ত্ব, সমাজবিদ্যা থেকে শুরু করে পরিবেশবিদ্যাকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। দেশেই যেন গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভব হয় আমাদের সমস্যার সমাধান।
টেকসই উন্নয়নের নামে আমরা যদি আবারও আগের মতোই বড় অবকাঠামোনির্ভর ব্যবস্থাগুলো প্রয়োগ করতে থাকি, তাহলে মায়া বা ইস্টার দ্বীপ বা রুয়ান্ডার মতো আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের পতন দেখতে হয়তো বেশি প্রজন্ম অপেক্ষা করতে হবে না।
● অনিমেষ গাইন: পরিবেশ পরিকল্পনা বিষয়ে গবেষণা ফেলো, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)।
● শিবলী সাদিক: উপকূল ব্যবস্থাপনা গবেষণা ফেলো, নেদারল্যান্ডসের আইএইচই ডেল্ফট ইনস্টিটিউট ফর ওয়াটার এডুকেশন।
●মফিজুর রহমান: বদ্বীপ ব্যবস্থাপনা গবেষণা ফেলো, জার্মানির কোলন ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স।