অর্ধশত ভাটায় পুড়বে ৭০ হাজার টন কাঠ
মাগুরা সদর উপজেলার ধলহারা গ্রামে অবস্থিত হিনো ব্রিকসে চলছে ইট পোড়ানোর প্রস্তুতি। ইট পোড়ানোর জন্য জড়ো করা হচ্ছে কাঠ। সাত বছর ধরে একইভাবে এখানে ইট পোড়াতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
কয়েক শ মিটার দূরত্বে একই গ্রামে মাগুরা-নড়াইল আঞ্চলিক সড়কের পাশে এনএফবি ব্রিকসে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে ইট পোড়ানো। গত সোমবার সরেজমিন দেখা যায়, ভাটার টিনের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর ভাটা এলাকায় প্রবেশ করছে কাঠবোঝাই ইঞ্জিনচালিত তিন চাকার যান। শ্রমিকদের কেউ সেই কাঠ নামাচ্ছেন, কেউ ফাড়ছেন। আর একদল শ্রমিক সেগুলো জড়ো করছেন চুল্লির পাশে নিয়ে।
জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানোর শুরু হয়েছে বা প্রস্তুতি চলছে মাগুরা জেলায় অর্ধশতাধিক ইটভাটায়। আইনে নিষিদ্ধ হলেও মাগুরায় ইটভাটায় দেদার কাঠ পোড়ানো চলছে বছরের পর বছর ধরে। প্রতিবছর ইট পোড়ানোর মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা এবং কিছু মামলা করে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর। এতেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
জেলা প্রশাসনের হিসাবে মাগুরায় ইটভাটার সংখ্যা ৯৮। সদর উপজেলায় ৫৫টি, মহম্মদপুরে ২৫টি, শ্রীপুরে ১১টি ও শালিখায় ৭টি ভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ইট পোড়ানোর লাইসেন্সের মেয়াদ আছে মাত্র ছয়টির। নতুন লাইসেন্সের জন্য আবেদন জমা পড়েছে একটি। মৌসুমের শুরু বলে জেলায় এ বছর কতগুলো ভাটায় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে, তার হালনাগাদ তথ্য এখনো জেলা প্রশাসনের কাছে আসেনি। তবে গত বছরের হিসাবে জেলায় মোট ৬১টি ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো হয়েছে। এসবের বেশির ভাগই টিনের চিমনির ভাটা। কংক্রিটের স্থায়ী চিমনির অনেক ভাটায়ও জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো হয়েছে।
মাগুরা ইটভাটা মালিক সমিতি অবশ্য বলছে, জেলায় ভাটা আছে ১০৩টি। এর মধ্যে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তৈরি জিকজ্যাক ভাটা ২৯টি। সেখানে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহৃত হয়। এ বছর নতুন ছয়টি ভাটা ব্যারেল চিমনি থেকে জিকজ্যাকে রূপান্তরিত হচ্ছে।
মূলত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ইট পোড়ানো হয়। প্রতিবছর ইটভাটার মৌসুমে মাগুরা জেলায় কী পরিমাণ কাঠ পোড়ানো হয়, তার সঠিক হিসাব সরকারি কোনো দপ্তরে পাওয়া যায়নি। তবে ভাটাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এর একটি ধারণা পাওয়া যায়। সদর উপজেলার ধলহারা গ্রামের এনএফবি ব্রিকসের ইট পোড়ানো শ্রমিক তারিকুল ইসলাম জানান, প্রতি হাজার ইট পোড়াতে গড়ে তাঁদের ১৮ মণ কাঠের প্রয়োজন হয়। আবহাওয়া ও কাঠের ধরনে কিছুটা কম-বেশি হয়। সে হিসাবে প্রতি লাখ ইট পোড়াতে গড়ে ৮০ টন কাঠ প্রয়োজন হয়।
ভাটা মালিক সমিতির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যারেল বা টিনের চিমনির প্রতিটি ভাটায় ১৫ লাখের বেশি ইট তৈরি হয়। চলতি বছর এই ধরনের অন্তত ৫৫টি ভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানোর প্রস্তুতি রয়েছে। সে হিসাবে এবার এসব ভাটায় প্রায় ৭০ হাজার টন কাঠ পোড়ানো হতে পারে। টনপ্রতি আড়াই হাজার টাকা হিসাবে এসব কাঠ সংগৃহীত হয় জেলার বিভিন্ন বন ও বাঁশবাগান থেকে।
ইটভাটাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিকজ্যাক ভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা পুড়িয়ে এক হাজার ইট তৈরিতে ব্যয় হয় গড়ে ৫ হাজার ৬০০ টাকা। সেখানে কাঠ পুড়িয়ে একই পরিমাণ ইট তৈরিতে খরচ সাড়ে চার হাজার টাকা। একটি জিকজ্যাক ভাটা স্থাপনে খরচ হয় সোয়া এক কোটি থেকে দেড় বা দুই কোটি পর্যন্ত। অথচ একটি টিনের চিমনির ভাটায় বিনিয়োগ করতে হয় সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে মাগুরা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি রবিউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সরকারি নিয়ম মেনে কোটি টাকা বিনিয়োগ করে পরিবেশবান্ধব ভাটা তৈরি করেছি। কিন্তু কেউ ব্যবসা করতে পারছি না। কাঠ পুড়িয়ে যারা ইট তৈরি করছে, তাদের উৎপাদন খরচ আমাদের থেকে প্রতি হাজারে অন্তত এক হাজার এক শ টাকা কম। কয়লা দিয়ে পোড়ানো ইটের মানও ভালো। অথচ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ওরা যে দামে ইট বিক্রি করছে, আমাদেরও সেই দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে প্রতিবছর আমরা লোকসান গুনছি।’
২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে বলা হয়েছে, ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা যাবে না। এর ব্যত্যয় হলে তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে এবং জরিমানা গুনেই ভাটায় কাঠ পুড়িয়ে যাচ্ছেন মালিকেরা।
সদর উপজেলার পাতুড়িয়া গ্রামে টিনের চিমনির ভাটা আছে মাজেদুল বিশ্বাসের। গত চার মৌসুমে একাধিকবার জরিমানা দিয়েছেন তিনি। প্রতিবছর গড়ে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা দিতে হয়েছে। মাজেদুলের মতো অনেকেই বছরের পর বছর জরিমানা দিয়ে অবৈধ ইটভাটা চালাচ্ছেন। ভাটাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাগুরায় বেশির ভাগ ভাটার লাইসেন্স নেই। জরিমানাও খুব বেশি হয় না। তাই জরিমানা দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন তাঁরা।
আইন অমান্য করে ইটভাটা স্থাপনের অভিযোগে গত মৌসুমে মাগুরায় ১২টি মামলা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রায় এক বছর পরও সেসব মামলার তদন্তকাজ শেষ করতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের যশোর জেলার উপপরিচালক নাজমুল হুদা বলেন, ‘মাগুরাসহ চারটি জেলা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। জনবলের সংকটের কারণে কার্যকরভাবে পুরো এলাকা নজরদারি করা সম্ভব হয় না। তা ছাড়া অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এসব কারণে অনিয়মগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়।’
মাগুরার জেলা প্রশাসক আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর যাতে আইন অমান্য করে কেউ ভাটা চালু করতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সব উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। তিন ফসলি জমিতে বা কাঠ পোড়ানো হবে, এমন নতুন কোনো ভাটা করতে দেওয়া হবে না।