পান্থকুঞ্জসহ সব গণপরিসর পুনরুদ্ধারের এখনই সময়: ইকবাল হাবিব

এক্সপ্রেসওয়ের একটি র‌্যাম্প পান্থকুঞ্জ পার্কের বুক চিরে কারওয়ান বাজার গোলচত্বরের দিকে নামানোর পরিকল্পনা হচ্ছে—এমন অভিযোগ করছেন পরিবেশবাদীরা। তাঁরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলনও করছেন। সম্প্রতি এ আন্দোলনের সময় পরিবেশবাদীদের দুই পক্ষের বচসা হয়। পান্থকুঞ্জের আন্দোলন, প্রকল্পের নকশা—এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন নগরবিদ ও পরিবেশবাদী ইকবাল হাবিব। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

প্রথম আলো:

রাজধানীর পান্থকুঞ্জ পার্কে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্পের কাজ বন্ধের জন্য আন্দোলন করছেন পরিবেশবাদীরা। এক্সপ্রেসওয়ের একটি র‌্যাম্প পান্থকুঞ্জ পার্কের বুক চিরে কারওয়ান বাজার গোলচত্বরের দিকে নামানোর পরিকল্পনা হচ্ছে বলে অভিযোগ পরিবেশবাদীদের। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

ইকবাল হাবিব: ঢাকার ‘কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা’ বা এসটিপি তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৯ শতাংশ চলাচল বা ট্রিপে লোকজন ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে থাকে।
সুতরাং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি অল্পসংখ্যক যানবাহনের জন্য তৈরি। অন্যভাবে বলা চলে যে এটি একটি ‘ধনী তোষণ’ নীতিমালার প্রকল্প, যেখানে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পটির কারণে ইতিমধ্যে গণপরিবহনের অন্যতম সাশ্রয়ী মাধ্যম, কমিউটার রেল সম্ভাবনার রেলপথের ঊর্ধ্বমুখী ও পার্শ্বমুখী সম্প্রসারণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপরন্তু যেকোনো নির্ধারিত উন্মুক্ত স্থান বা গণপরিসরের ক্ষতি করে প্রকল্পের উড্ডয়ন বা অবতরণের কার্যক্রম সার্বিক অর্থে অবশ্যই ক্ষতিকর।

প্রথম আলো:

আপনি নগরবিদ শুধু নন, পরিবেশবাদীও। সেই নিরিখে পান্থকুঞ্জ রক্ষার আন্দোলনকে আপনি কীভাবে দেখেন?

ইকবাল হাবিব: ঢাকা শহর তথা সারা দেশের নগরায়ণে উন্মুক্ত সবুজ পার্ক বা গণপরিসর এমনিতেই ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মানের থেকে অনেক কম। অপরিকল্পিত নগরায়ণ আর ক্রমাগত বেদখলের শিকার সবুজ গণপরিসর বা উন্মুক্ত স্থান রক্ষার জন্য শান্তিপূর্ণ যেকোনো কর্মসূচি পরিবেশবান্ধব ও জনবান্ধব নগর গড়ে তোলার লক্ষ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অতএব এ আন্দোলনকে শুধু সাধুবাদই নয়; বরং অবিলম্বে আলোচ্য দাবির ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আশু নিরসনই প্রত্যাশিত।
পান্থকুঞ্জসহ সব গণপরিসরকে ফিরিয়ে আনাই আমাদের কাম্য। পান্থকুঞ্জসহ সব গণপরিসর পুনরুদ্ধারের এখনই সময়।

প্রথম আলো:

আপনি পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আছেন। গত বৃহস্পতিবার বাপার কর্মীদের সঙ্গে বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে বচসা হয়। বিষয়টি নিয়ে কিছু বলবেন?

ইকবাল হাবিব: বিষয়টি অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। বর্তমান সময়ে প্রায় ‘সংখ্যালঘু’ পরিবেশকর্মীদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষায় দৃঢ় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সেই হিসেবে সবার সংযত ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক উন্নয়ন যেমনি জরুরি, পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে সব ধরনের ভুল–বোঝাবুঝি নিরসন করে একসঙ্গে কাজ করায় প্রত্যয়ী থাকা কাম্য।

প্রথম আলো:

পান্থকুঞ্জ পার্ক রক্ষা ঘিরে যে আন্দোলন, যে প্রকল্পের বিরুদ্ধে এখন অবস্থান পরিবেশবাদীদের, সেই প্রকল্পের নকশা আপনার করা বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

ইকবাল হাবিব: এ অভিযোগ একেবারেই সঠিক নয়! মূলত ২০১১ সালে উদ্বোধন করা এ প্রকল্পের নকশায় পান্থকুঞ্জ পার্কের অভ্যন্তরে র‍্যাম্প নামানোর পাশাপাশি একটি কন্ট্রোল টাওয়ার নির্মাণের প্রস্তাব ছিল, যার ফলে সম্পূর্ণ পার্কটি ধ্বংস হয়ে যেত। সেই সঙ্গে প্রকল্পটির কারণে আমাদেরই নকশা করা হাতিরঝিলের অবাস্তবায়িত অংশের অবশ্যম্ভাবী পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ক্ষতি হতো। এই সম্ভাব্য ক্ষতি পুনরুদ্ধারে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং বর্তমানে বুয়েটে অধ্যাপনা ও গবেষণারত অধ্যাপক শামসুল হক স্যারের পরামর্শে ‘হাতিরঝিলের মূল স্থাপত্য ও নৈসর্গিক নকশাকারী’ হিসেবে আমরা ‘ইএমপি’ বা ‘এনভায়রনমেন্টাল মিটিগেশন প্ল্যান’ প্রণয়ন করায় সচেষ্ট হয়েছি। সেই পরিকল্পনায় মূলত হাইকোর্টে মামলা থাকার কারণে হাতিরঝিলের মূল নকশার সঙ্গে বাস্তবায়িত না হওয়া এই অংশটুকুর গণপরিসর হিসেবে ব্যবহারের লক্ষ্যে উত্তরণ ও উন্নয়নের সুস্পষ্ট প্রস্তাব ছিল।

একই সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারণে হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জে যেসব অভিঘাত হতে পারে, তার ত্রিমাত্রিক উপস্থাপনার মাধ্যমে সেসব প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছে তুলে ধরে তার প্রতিবিধানের চেষ্টাও করেছি।

প্রথম আলো:

নগরের পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সব সময় দেখা গেছে, পরিবেশবাদীরা এককাট্টা থেকেছেন। এবার এর ব্যত্যয় হলো। কেন এটা হলো বলে আপনার মনে হয়?

ইকবাল হাবিব: পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংসকারী শক্তিশালী শাসক গোষ্ঠীরা সব সময়ই পরিবেশবাদীদের মধ্যে বিভেদ আর ‘ডিজইনফরমেশন’ বা ‘তথ্যভ্রান্তি’র মাধ্যমে বিভ্রান্তি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে দুর্বল বা ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা জারি রেখেছে। এই সময়ে চারপাশের অস্থিরতার সুযোগে এবং আমাদেরও কিছুটা অসতর্ক অদূরদর্শিতার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগের অভাবের কারণেই এ ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করি। তবে বিশ্বাস করি, সবার সার্বিক প্রচেষ্টায় এসব ভুল–বোঝাবুঝির দ্রুত নিরসনের মধ্য দিয়ে অবস্থার উন্নয়ন হবে এবং আমাদের আন্দোলনও সামষ্টিকভাবে আরও বেগবান ও শক্তিশালী হবে।

প্রথম আলো:

বাপার কার্যক্রমের অর্থায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে কিছু বলবেন?

ইকবাল হাবিব: বাপা বিদেশি সাহায্যপুষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। বাপা একটি সদস্যভিত্তিক পরিবেশবাদী সামাজিক জাতীয় প্ল্যাটফর্ম। বাপার সদস্য ও অংশীদারেরা নিজ উদ্যোগে ও নিজ অর্থায়নে পারস্পরিক সহযোগিতায় দেশজুড়ে ২৫ বছর ধরে সব ঘাত-প্রতিঘাত আর বাধা অতিক্রম করে পরিবেশ সুরক্ষায় আন্দোলন পরিচালনা করে আসছে। বাপার গঠনতন্ত্র মোতাবেক কোনো বিদেশি দাতা সংস্থা থেকে আর্থিক সহায়তা গ্রহণ সম্পূর্ণভাবে নিষেধ। বরং পরিবেশবাদী এনজিও বা সামাজিক সংগঠন, শিক্ষাবিদ বা গবেষণাকর্মী এবং মাঠপর্যায়ের নিবেদিতপ্রাণ পরিবেশকর্মীদের মাধ্যমেই দেশব্যাপী সব কর্ম পরিচালনা করে থাকে। এভাবেই বাপা নিজস্বভাবে এবং অন্যান্য সহযোগী সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও যৌথভাবে পরিবেশ সুরক্ষায় আন্দোলন ও প্রচারাভিযান পরিচালনা করে থাকে। এ ছাড়া বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টের (বেন) সদস্যরাও তাঁদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান এবং সামষ্টিক চাঁদা প্রদান করেও বাপাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেন। বাপার অর্থায়ন নিয়ে আরও প্রশ্ন থাকলে আমাদের অফিসে এসে বার্ষিক আর্থিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেখার আহ্বান জানাই।