হেমন্তের মাঠের সেই পাখি
হেমন্ত এলে বাংলার গ্রামীণ প্রান্তরের ফসলের মাঠ খালি হয়ে যায়। অনুভব করা যায় শামুকের খোলসে লেগে থাকা শিশিরের নীরবতা। মেঠো ইঁদুরের গর্ত ও চলার পথগুলো দেখা যায়। গাঁয়ের মাঠে খুব সকালে খাবার খুঁজতে দেখা যায় পতঙ্গভুক পাখিকে (পাকড়া শালিক, কালো ফিঙে)। ফসলের ঘ্রাণ মাঠ থেকে চলে যায় চাষিদের বাড়িতে। রাতের আঁধারে খোলা মাঠে ইঁদুর ধরতে চলে আসে বাংলার প্যাঁচারা। তারা জেগে থাকে হেমন্তের মাঠে।
কবি জীবনানন্দ দাশের ‘পেঁচা’ কবিতার কয়েকটি লাইন হেমন্ত এলে কিংবা প্রান্তরের খোলা মাঠ দেখলে মনে পড়ে যায়। যেমন— ধানক্ষেতে– মাঠে/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা!/ ঘরে গেছে চাষা;/ ঝিমায়েছে এ পৃথিবী,/ তবু পাই টের/ কার যেন দুটো চোখে নাই এ–ঘুমের/ কোনো সাধ!/ হলুদ পাতার ভীড়ে ব’সে,/ শিশিরে পালক ঘ’ষেÑ ঘ’ষে,/ পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে,/ ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখেÑ দেখে/ মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে/ জাগে একা অঘ্রানের রাতে/ সেই পাখি—/ আজ মনে পড়ে।
প্যাঁচা নিয়ে কোনো কবির এত মায়াবী কবিতা কোথাও আর দেখিনি। প্যাঁচা নিশাচর পাখি। বাংলায় ১৭ প্রজাতির প্যাঁচা দেখা যায়। দেশের বনে (পাহাড়ি বন, সুন্দরবন, শালবন), গ্রামীণ বন, ভিটার ঝোপের আড়ালে দিনের বেলায় প্রায় সব প্রজাতির প্যাঁচা লুকিয়ে থাকে অথবা চুপচাপ বসে থাকে। নড়াচড়াও করে খুব কম। সূর্যের আলো নিভে গেলে তাদের কর্মচঞ্চল হতে দেখা যায়।
আমাদের দেশের সবচেয়ে সহজদৃষ্ট খুঁড়ুলে প্যাঁচা সন্ধ্যা নামলে উচ্চ স্বরে ডাকতে শুরু করে। চাঁদনি রাতে পাহাড়ি বনের প্যাঁচারাও ডাকাডাকি করে। গ্রামের ফসলের মাঠে রাতের বেলায় গেলে প্যাঁচার ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যায়। কখনো ধানখেতের আইলের উঁচু ঢিবিতে বসে থাকতে দেখা যায় শিকার ধরার জন্য।
বাংলাদেশের প্যাঁচা প্রজাতিগুলোর মধ্যে বিরল একটি প্রজাতি হলো মেটে হুতোমপ্যাঁচা। এই প্রজাতির প্যাঁচা প্রধানত দেশের গভীর বনে দেখা যায়। বিশেষ করে আমাদের সুন্দরবন, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে। বান্দরবানের সাঙ্গু বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে গিয়ে বছর পাঁচেক আগে মেটে হুতোমপ্যাঁচা দেখেছি। সম্প্রতি বিরল প্রজাতির এক জোড়া মেটে হুতোমপ্যাঁচা দেখা গেছে মেহেরপুরের আমঝুপিতে। মেহেরপুরের স্থানীয় বন্য প্রাণী সংরক্ষণকর্মী বখতিয়ার হামিদ সে তথ্য আমাকে জানান। প্রায় এক সপ্তাহ পাখি দুটি আমঝুপিতে ছিল। তিনি আরও জানান, পাঁচ বছর আগে সর্বশেষ মেটে হুতোমপ্যাঁচা মেহেরপুরে দেখা গিয়েছিল। তাঁর ধারণা, পাখি দুটি আমাদের সুন্দরবন কিংবা ভারত থেকে মেহেরপুরে আসতে পারে।
মনে হচ্ছে, মেটে হুতোমপ্যাঁচা গভীর বন থেকে হেমন্তে গ্রামবাংলার দিকে উড়ে আসে খাবারের জন্য। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্যাঁচা। কানের ওপর বিশাল ঝুঁটি দেখে এটিকে খুব সহজে শনাক্ত করা যায়। এ পাখির ইংরেজি নাম ডাস্কি ইগল-আউল বা হর্ন আউল। মেটে হুতোমপ্যাঁচা বড় গাছে বসবাস করে। রাতের বেলায়, ভোরে ও গোধূলিতে কর্মতৎপর থাকে।
প্যাঁচা উপকারী পাখি। চাষিদের বন্ধু। প্যাঁচা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, খাদ্যশৃঙ্খলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, চীন ও মালয়েশিয়ার বনে মেটে হুতোমপ্যাঁচা দেখা যায়।
সৌরভ মাহমুদ: নিসর্গী ও পরিবেশবিদ