জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: সরেজমিন সিলেট ও পিরোজপুর
দাসত্বের শিকার জলবায়ু অভিবাসীরা
আইআইইডির প্রকাশিত এক গবেষণায় বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রগুলোতে দাসত্বের বিষয়টি উঠে এসেছে।
সিলেটের গোয়াইনঘাটের লেঙ্গুড়া এলাকা থেকে বছর তিনেক আগে সাভারে এসে পোশাক কারখানায় কাজ নেন আফজাল হোসেন (৪০)। তাঁর সঙ্গে এলাকার আরও জনা তিনেক পুরুষও এসেছিলেন তখন। একই ভাড়া বাসায় উঠেছিলেন। এলাকায় কাজের অভাব, মজুরি কম; এক দিন কাজ থাকলে সাত দিন নেই। এভাবে অনিশ্চয়তায় দিন পার করা আফজাল যখন ঢাকায় এসে কাজ পান, তখন বেতন ছিল সাড়ে সাত হাজার টাকা। কিন্তু বাসা ভাড়া, খাওয়ার খরচ আর গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর পর মাসের শেষ দিকে হাতে আর কোনো টাকাই থাকত না। ধারকর্জ করে মাস শেষ করতে হতো। এভাবে দিনের পর দিন পার করছিলেন। সম্প্রতি শেষ সম্বল চাকরিটাও খুইয়েছেন।
গত সোমবার ঢাকার সাভার বাজার মোড়ে কথা হয় আফজালের সঙ্গে। তিনি তখন কাজ খুঁজছিলেন। বললেন, ‘হাড়ভাঙা খাটুনি, দেরি করলে বেতন কাটা, কথায় কথায় গালি আর মাসের শেষে পকেটেও কিছু নেই। এই কাজের কোনো মানে হয় না। শখ কইরা ১০০ টাকাও নিজে খাইবার পারি না। আবার এলাকায় যে ফিরব, গিয়া করমু কী? বাড়িতে এক ছেলে, এক মেয়ে, বউ, অসুস্থ বাবা-মা, তাগো কথা ভাইবা আর ফেরা হয় না। আমার নিজের ইচ্ছার কোনো দাম নাই। আমি মানুষের হুকুমের গোলাম।’
জলবায়ু ঝুঁকির সঙ্গে অভিবাসন এবং আধুনিক দাসত্বের যোগসূত্র বুঝতে সিলেট ও পিরোজপুরে জরিপ চালানো হয়। এই দুই এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ স্পষ্ট।রিতু ভরদ্বাজ, প্রধান গবেষক, জলবায়ু পরিবর্তন, আইআইইডি
সাভারের যে তৈরি পোশাক কারখানায় আফজাল কাজ করতেন, দিন কয়েক আগে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। বেতনের জন্য তিনি আর অন্য শ্রমিকেরা ৩ মার্চ ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছিলেন। কোনো কাজ হয়নি। দুই সপ্তাহ ধরে বেকার বসে আছেন। তাই নতুন কোনো কাজের খোঁজে বেরিয়েছিলেন।
আফজালের এমন দশা বাংলাদেশের আধুনিক ‘দাসত্বের’ একটি চিত্র। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (আইআইইডি) প্রকাশিত এক গবেষণায় বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রগুলোতে দাসত্বের বিষয়টি উঠে এসেছে। ‘এক্সপোজড অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেড: ক্লাইমেট চেঞ্জ, মাইগ্রেশন অ্যান্ড মডার্ন স্ল্যাভারি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণাটিতে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সহায়-সম্বল হারিয়ে মালিকপক্ষের দাস হয়ে উঠছে বাংলাদেশের জলবায়ু অভিবাসীরা।
গবেষণার সূত্র ধরে খোঁজ নিতে গিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে অভিবাসী হয়েছেন, এমন পরিবারের অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। পিরোজপুরের বলেশ্বর নদের জেলে বেল্লাল খন্দকার (৩৫) তেমনই একজন। জেলার মঠবাড়িয়ার বড় মাছুয়ার খেজুরবাড়ি এলাকার বাসিন্দা বেল্লাল মাছের আড়তের মহাজনের কাছ থেকে অগ্রিম দাদনসহ বিভিন্ন এনজিও থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ঋণ করেছিলেন। পরিশোধ করতে না পেরে এলাকা ছেড়েছেন। তাঁর আত্মীয়স্বজন জানান, বেল্লাল এখন চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন।
বেল্লাল খন্দকারের মা রেনু বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বলেশ্বর নদে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। প্রতিদিন ১০-১৫টি ছোট সাইজের ইলিশ পাওয়া যায়। সেই মাছ বিক্রি করে আমার ছেলে মহাজনের দেনা পরিশোধ করতে পারে নাই। উল্টা তার দেনা আরও বাড়ছে। পরে চট্টগ্রামে চলে যেতে হইছে তাকে।’
২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকেই তাঁদের জীবন-জীবিকার পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে বলে জানান রেনু। তিনি বলেন, ‘ছেলেটা যে কেমন আছে নাতিপুতি লইয়া, ওর কথা মনে হইলেই মনডা কেমন করে।’
দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, নারী ও উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে কাজ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিরা অভিবাসী হন অদক্ষতা নিয়ে। যে কাজ তাঁরা শুরু করেন, সেটা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে কাজ করতে সাহস পান না। ফলে তাঁদের পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হয়। তৈরি পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়।
অধ্যাপক শরমিন্দ আরও বলেন, ইটভাটা বা নির্মাণশ্রমিকেরা আসলে নানা ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তাঁরা আগে থেকেই দাদন নিয়ে রাখেন, ফলে মালিকপক্ষ যে পারিশ্রমিক দেয়, তা নিয়েই তাঁদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। দেশের বাইরে যাওয়া নির্মাণশ্রমিকদের ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়ে অসহনীয় পরিস্থিতি মেনে নেওয়া ছাড়া আসলে উপায় নেই।
কী এই আধুনিক দাসত্ব
‘সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ছোটগল্প ‘হৈমন্তী’তে শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও মানবিক মূল্যবোধ উপস্থাপন করতে ‘সম্পদ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। আর যা ব্যবহার করা যায়, প্রয়োজন হলে হস্তান্তর করা যায়—এমন ব্যক্তি বা বস্তুকে ‘সম্পত্তি’ বুঝিয়েছিলেন। কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিকে যখন সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়, ব্যক্তিগত অধিকার কেড়ে নিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে কাজে নিযুক্ত করা হয়—এমন পরিস্থিতিকে আধুনিক দাসত্ব বলছে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন।
মানবসভ্যতার ইতিহাস বলছে, প্রথম ক্রীতদাস প্রথা চালু হয় প্রায় ছয় হাজার বছর আগে। পরে এই প্রথা মিসর হয়ে ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। মিসরের গ্রেট পিরামিড, চীনের মহাপ্রাচীরের স্থাপনার সঙ্গে দাসত্বের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করা হয়। আইআইইডির প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, দাসত্ব এখন আধুনিক হয়েছে। ২০২২ সালে কাতারে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশ থেকে যে শ্রমিকেরা কাজ করেছেন, তাঁরা আধুনিক দাসত্বের শিকার।
আইআইইডির গবেষণায় জোরজবরদস্তি করে কাজ করানো, জোর করে বিয়ে, যৌন শোষণ, অমানবিক কাজের পরিবেশ, অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, চলাফেরার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, বেতন আটকানো, ধমক এমনকি মারধর, প্রবাসীদের ক্ষেত্রে ভিসা পাসপোর্ট জব্দ করা, অতিরিক্ত ও বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করার মতো ঘটনাকে আধুনিক দাসত্ব হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, এই অভিবাসীরা মূলত ইটভাটা, নির্মাণকাজ, গৃহস্থালির কাজ, তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। এসব জায়গায় আনুষ্ঠানিক চুক্তি বা কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ছাড়াই অনেক সময় দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কম মজুরি ও বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসীদের অন্তত ৯২ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে দাস হয়ে উঠছেন। প্রবাসীদের অনেকেই দাসত্বের শিকার।
আইআইইডি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ১০টি ও সিলেটের গোয়াইনঘাটের ৯টি ইউনিয়নের মোট ৩৩টি গ্রামে জরিপ করে গবেষণাটি করেছে। তারা মোট ৬৪৮টি খানায় জরিপ চালিয়েছে, যার মধ্যে ৭০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ খানায় অভিবাসী পাওয়া গেছে। সিলেট জেলাকে দ্রুতগতির এবং পিরোজপুরকে ধীরগতির জলবায়ু প্রভাবের নমুনা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
গবেষণার নেতৃত্ব দেওয়া আইআইইডির প্রধান জলবায়ু পরিবর্তন গবেষক রিতু ভরদ্বাজ প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ু ঝুঁকির সঙ্গে অভিবাসন এবং আধুনিক দাসত্বের যোগসূত্র বুঝতে সিলেট ও পিরোজপুরে জরিপ চালানো হয়। এই দুই এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ স্পষ্ট। সিলেটে আকস্মিক বন্যা এবং অতিবৃষ্টি বেশি হয়। ফলে পানিতে ফসলের মাঠ ডুবে যাওয়া, ধানের খেত নষ্ট হয়ে যাওয়া, মুহূর্তেই ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়ার প্রবণতা সেখানে বেশি। অন্যদিকে সমুদ্র উপকূলবর্তী পিরোজপুরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততার প্রভাব বেড়ে গেছে।
দুর্যোগে দিশাহারা, খাবারের অভাব
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় বিরানভূমি পড়ে আছে, ফসল নেই। পুরুষ মানুষের আনাগোনাও কম। এলাকার মানুষ জানালেন, হয় বিদেশে, নইলে সিলেট বা ঢাকায় কাজের জন্য থাকেন পুরুষেরা। আর কাজ না থাকলে নারীরা ঘরের বাইরে বের হন না।
উপজেলার লাফনাউট বাজারে ধানখেতে কাজ করছিলেন ২৩ বছরের তরুণ আশরাফ। সঙ্গে কাজ করছিল তাঁর শ্যালক অনিক (৮) ও আশিক (১০)। আশরাফ মূলত সিলেট শহরের একটি খাবার হোটেলে কাজ করেন। আশরাফ বলেন, ‘শ্বশুরবাড়ির এই দিকে কামের লোকের অভাব। লোক পাই না। নিজেরাই কাম করতাছি। মাঠ তো পইড়া আছে, যদি আবাদ কইরা লাভ হয়, এই আশায় ধান লাগাইতাছি।’
এলাকার কয়েকজন কৃষক জানান, কাজের লোক পাওয়া যায় না, এর মধ্যে অতিবৃষ্টি আর বন্যার প্রকোপে বিঘার পর বিঘা ফসলি জমি নষ্ট হয়। এ জন্য মানুষ এখন দীর্ঘমেয়াদি ফসল চাষ করা ছেড়ে স্বল্পমেয়াদি ফসলের দিকে ঝুঁকছে। লাফনাউট বাজারের তরমুজ বিক্রেতা কামাল আহমেদ বলেন, ‘বচ্ছরের বেশি সময় বইসাই থাকি, খাম-খাজ নাই। অখন তরমুছ বিক্রি কইরা প্যাট চালাইতাছি। আবাদ অয় না। ভাবতাছি সিলেট শহরে চইলা যামু। আর পারতাছি না।’
আইআইইডির গবেষণায় তথ্যদাতাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি পরিবার জানিয়েছে, লবণাক্ততা, অনিয়মিত বৃষ্টি এবং বন্যার কারণে তাদের ফসলের উৎপাদন কমে গেছে। প্রায় ৬৬ শতাংশ পরিবার বলছে, পানির উষ্ণতা ও লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে মাছের উৎপাদন কমে গেছে, যা তাদের খাবার ও রোজগারের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এর বাইরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া, গবাদিপশু মারা যাওয়া তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ধান, শাকসবজি, ডালসহ আরও বেশ কিছু ফসলের আবাদ হতো। তবে পানিতে অতিমাত্রার লবণ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে পান, পাট, তিল, শর্ষে অনেকটা বিলুপ্তপ্রায়। এখন আমনের মৌসুমে শুধু ধান চাষ করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় কৃষকদের।
কৃষকেরা বলছেন, আমনের পর বছরের বাকি সময় জমিতে উচ্চমাত্রার জোয়ারের পানিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। গভীর নলকূপের পানিতেও এখন লবণাক্ততা দেখা গেছে, যে কারণে সেচ দেওয়া যায় না। ফলে কৃষকেরা চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছেন। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর এ এলাকার সর্বত্র লোনাপানি ঢুকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের অক্টোবরের ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে সৃষ্ট উঁচু জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে এ অঞ্চলের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
আইআইইডির গবেষণায় ১৯৬০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, এই ৬৩ বছরে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। আর ক্ষতি বেড়েছে চার গুণ। পিরোজপুরে প্রতি খানায় গড়ে বছরে ৮৭৩ ডলারের (১ লাখ ৭ হাজার ৩৭৯ টাকা) সম্পদ নষ্ট হয়েছে। সিলেটে নষ্ট হয়েছে ৭৩৫ ডলারের (৯০ হাজার ৪০৫ টাকা)।
মঠবাড়িয়ার বড় মাছুয়া ইউনিয়নের খেজুরিয়া এলাকার জেলে মজিবর রহমান বলেন, ‘বলেশ্বরে আমি ছোটবেলা থেকেই গোসল করছি, মাছ ধরছি। নদের পানিতে এখন লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে। কীভাবে আসছে বা কোথা থেকে আসছে, জানি না। এই পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। গভীর নলকূপের পানিতেও অতিমাত্রায় লবণ। লবণের কারণে মাটির উর্বরতা কমে গেছে।’
গবেষকেরা সিডর ও আম্পানের মতো বড় ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি পর্যালোচনা করে দেখেছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো আগের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। পিরোজপুরের প্রায় সব মানুষ মনে করেন, তাঁদের এলাকায় তাপমাত্রা বাড়ছে। নদীভাঙন তো আছেই। পিরোজপুর ও সিলেটের ৬৯ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের ঘরবাড়ি কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে বাড়িঘর হারিয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে মানুষ।
এলাকা ছাড়ছে মানুষ
সম্প্রতি গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের পাশে আসবাবপত্রের ব্যবসায়ী রাকিব উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর প্রতিবেদকের। উপজেলার ডৌবাড়ী ইউনিয়নের হাকুর বাজারের এই বাসিন্দার বাড়ি বন্যায় ডুবেছে পরপর দুই বছর। নতুন করে বাড়ি তৈরি করতে প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। বিক্রির জন্য দোকানে রাখা আসবাবপত্রও নষ্ট হয়েছে তাঁর। রাকিব বলেন, ‘এ রকম পরিস্থিতিতে এলাকা ছাড়ার কথা ভেবেছি, কিন্তু বাড়িতে অসুস্থ মা-বাবা রেখে যাওয়া হয় নাই।’ তাঁর আশপাশের ২০-২৫ জন এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে গেছেন।
২০১১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অনেক পরিবার দেশের এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলে গেছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। একই সময়ে বিদেশেও পাড়ি দেওয়া শুরু করেছে মানুষ। এ অভিবাসীদের বেশির ভাগই আবার যাচ্ছেন উপসাগরীয় দেশগুলোতে। প্রবাসীদের তিন ভাগের এক ভাগ ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত কাতার বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণে এই শ্রমিকেরা অংশ নিয়েছিলেন।
মঠবাড়িয়ার বড় মাছুয়া, তুষখালী ও বেতমোর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, এলাকার বাসিন্দারা বলেশ্বর নদে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাদবাকি মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। বাসিন্দারা বলছেন, মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময়কালে হয় মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিতে হয় অথবা বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সংসার চালাতে হয়। কিন্তু প্রত্যাশিত মাছ ধরতে না পেরে ঋণ আর পরিশোধ করা হয় না।
মঠবাড়িয়ার বড় মাছুয়ার জেলে মোস্তফা মৃধা বলেন, ‘বলেশ্বর নদে আমরা যারা মাছ ধরি, তাদের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। মাছ পাওয়া গেলে এসব দুর্যোগরে কিছু মনে হয় না। কিন্তু এখন নদীতে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। আমার ছেলে আবু সালেহ ঋণগ্রস্ত হয়ে স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রামে চলে গেছে।’
আইআইইডির গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু ঝুঁকির কারণে পরিবারগুলোর দেশের ভেতরে অন্য শহরে যাওয়ার সম্ভাবনা ১৬১ শতাংশ বেড়ে গেছে। আর দেশের বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে ২১৪ শতাংশ।
‘দাস’ হয়ে উঠছেন যেভাবে
গোয়াইনঘাট উপজেলার হাকুর বাজারের বাসিন্দা ছিলেন মোজাম্মেল মিয়া। এখন ঢাকার আশুলিয়ায় থাকেন। সেখানে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করে সংসার চালান তিনি। প্রথম আলোকে মোজাম্মেল বলেন, ‘বন্যাত বাড়ি ভাইঙ্গা গ্যাছে আর বানাই নাই, অমনেই আছে। এলাকাত গেছিও না দুই বচ্ছর। আমার লগে তো এলাকার আরও অনেক লোক আইছে। তারার সবোই আমার মতোই। ইখানো আমরার কষ্টের জীবন। নিজোর জমিজমা পইড়া আছে আর আমরা খাম খইরা কামলা দিয়া বেড়াইরাম। নিজের ইচ্ছা বলতে গেলে কিচ্ছু নাই।’
পিরোজপুরের কয়েকজন অভিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের অধিকাংশ ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছেন। চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় কনটেইনার লোড-আনলোডের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন কেউ কেউ। বাড়িতে থাকেন বৃদ্ধ মা-বাবা। কেউ বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে চলে গেছেন।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে অভিবাসী হওয়া অন্তত আট ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। বর্তমান কর্মক্ষেত্রে হুমকি আসতে পারে এমন আশঙ্কায় তাঁরা গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, এলাকায় যখন আর কোনো কাজ থাকে না, তখন অপারগ হয়ে পরিবারের সিদ্ধান্তে এলাকা ছাড়েন কাজ করতে। তাঁদের অধিকাংশ কৃষি ও মৎস্যক্ষেত্রে কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শিল্পকারখানায় কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কোনোরকম প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা ছাড়াই বড় শহরের উদ্দেশে পাড়ি জমান তাঁরা। পরিচিত-অর্ধপরিচিত মানুষের সহযোগিতা নিয়ে কোনো না কোনো কাজে যুক্ত হন।
অভিবাসীদের ভাষ্য, শহরে এসে নতুন কাজে পারদর্শী হতে যথেষ্ট সময় লেগে যায়। কাজটা যেহেতু তাঁরা ভালোমতো বোঝেন না, তাই শেখার জন্য সেখানে থাকতেই হয়। এই সুযোগে ইচ্ছেমতো বেতন নির্ধারণ করে মালিকপক্ষ।
তাঁরা বলেন, বিষয়টি শুধু বেতন আটকে রাখা বা কম মজুরি দেওয়ার মধ্যে থেমে থাকে না। কাজে এদিক-সেদিক হলেই ইচ্ছামতো গালিগালাজ করা হয়। মারধরের ঘটনাও ঘটে। কাজ চলাকালে অসুস্থ্ হয়ে পড়লেও কিছু করার থাকে না, কাজ করেই যেতে হয়। সব সময় মালিকপক্ষের দয়ার ওপর বেঁচে থাকতে হয় তাঁদের। ছুটির অভাবে আত্মীয়স্বজন মারা গেলেও দেখতে যাওয়া হয় না। অভিবাসীরা বলছেন, এমন পরিবেশে কাজ করতে করতে নিজেদের আর মানুষ মনে হয় না।
এই মানুষেরা মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রথম দিকে খেয়েপরে বেঁচে থাকার তাগিদে অভিবাসী হন বলে আইআইইডির গবেষণায় বলা হয়েছে। কিন্তু একবার অভিবাসী হলে ধীরে ধীরে অসহায়ত্ব বাড়তে থাকে। যে সচ্ছলতার আশা নিয়ে মানুষ এলাকা ছাড়েন, তা অপূর্ণ তো থাকেই; বরং আরও বেশি অনিশ্চিত জীবনের দিকে চলে যান তাঁরা। প্রয়োজনীয় সম্পদের অভাব, সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং আইনি সুরক্ষা না থাকার কারণেই এমনটি ঘটে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
দেশের বাইরে যাওয়া অভিবাসীদের অসহায়ত্ব আরও বেশি। কারণ, তাঁরা ঋণ করে বিদেশে যান, ঋণ পরিশোধ না করে দেশে ফেরা তাঁদের জন্য প্রায় অসম্ভব বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি দেশ থেকে অনেক বেশি দূরত্ব, পরিবহনের অতিরিক্ত ব্যয় আর দিন শেষে পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর চিন্তায় মুখ বুজে সব সহ্য করেন তাঁরা।
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, পিরোজপুরে ৪ লাখ ৬১ হাজার ২২০ আর সিলেটে ৪ লাখ ১৩ হাজার ৬৬৭ টাকা খরচ করে একেকটি পরিবার বিদেশে যাচ্ছে। টাকার জোগাড় হচ্ছে জমি বিক্রি বা চড়া সুদের ঋণের মাধ্যমে। আবার অভিবাসীরা তাদের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন নয়, ফলে সহজে প্রতারিতও হচ্ছে।
গবেষণাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুর্যোগের কারণে এলাকায় মানুষের যখন বিকল্প কর্মসংস্থান থাকে না, তখন পারিবারিকভাবে অভিবাসনের সিদ্ধান্ত হয়। পরিবারগুলো থেকে কমপক্ষে একজন কাজের সন্ধানে এলাকার বাইরে যায়। কিন্তু এই অভিবাসীদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের অল্প পারিশ্রমিকে কাজে নিযুক্ত হতে হয়।
ভালো নেই স্থানীয়রাও
গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের পাশে সবজির দোকান আবদুল আমিনের। মধ্যবয়স্ক এই ব্যক্তির মুখে হতাশার ছায়া। তাঁর কাজে সহায়তা করছে ছয় বছরের ছেলে সোহাগ। বাবা আলুর বস্তার মুখ খুলে ধরে আছে আর ছেলে সেখান থেকে আলু নামিয়ে দোকানে বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখে। কাছে যেতেই বললেন, জীবনযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার গল্প। দুই ছেলে আর দুই মেয়ে তাঁর। বছর বছর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি জোড়াতালি দিতেই ধারকর্য করতে হয়। সবজির দোকানের আয়ে এত মানুষের পেট চালানো দায়।
ফ্যাকাশে মুখে আবদুল আমিন বলেন, ‘ছেলেটারে দেখতাছেন যে স্কুলের বয়স হইয়া গেছে। ছয় বছ্ছরে তো স্কুলে দিতাম পারি নাই। খাম খরে আমার লগে। খেইলা বেড়ায়। আমারে জিগায় আব্বা আমি কি স্কুলে যামু না? আমি কিছু খইতাম পারি না বাবা।’ হতাশাগ্রস্ত বাবা কথা বলে আর ছেলে সোহাগ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বাবার মুখের দিকে।
সমাধান কী
গবেষণায় জলবায়ু অভিবাসীদের আধুনিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে ছয়টি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো: স্থানীয়ভাবে জলবায়ু সহিষ্ণুতা তৈরি, জীবন ও জীবিকার সুযোগ বাড়ানো, অভিবাসীদের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানো, সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানো, নিরাপদ অভিবাসনের পথ তৈরি এবং আর্থিক নিরাপত্তা সৃষ্টি ও জলবায়ু অর্থায়নের ব্যবহার।
বাংলাদেশে এসব বিষয়ে অল্প কিছু কর্মসূচি চালু আছে বলে জানিয়েছেন গবেষক দলের নেতা রিতু ভরদ্বাজ। তবে সবচেয়ে প্রান্তিক ও বিপন্ন মানুষদের কাছে এসব কর্মসূচির সুবিধা সহজে পৌঁছায় না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
রিতু ভরদ্বাজ প্রথম আলোকে বলেন, লিঙ্গ, ধর্ম, শিক্ষা ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার ভিত্তিতে সৃষ্ট বৈষম্যের কারণে এসব কর্মসূচির সুবিধা প্রায়ই বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে মানুষ কম উপকৃত হচ্ছেন। এগুলোর মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে এবং সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য কর্মসূচির সুবিধা উন্মুক্ত করতে হবে।
রিতুর পরামর্শ, সরকারের উচিত অভিবাসীদের জন্য একটি পরামর্শ হেল্পলাইন চালু করা। পাশাপাশি অভিবাসীদের জন্য আলাদা চাকরি নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা দরকার, যেন তারা শোষণমূলক ও অনিরাপদ কাজের বেড়াজালে সহজেই হারিয়ে না যায়।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন এ এস এম মাহমুদুর রহমান, ঝালকাঠি]