কোমল পাপড়ির সুগন্ধি শিরীষ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফুটেছে শিরীষছবি: লেখক

সাধারণভাবে অনেকেই শিরীষ বলতে কড়ইগাছকে বুঝে থাকেন। অথচ প্রতিটি কড়ইগাছের আলাদা পরিচয় আছে। উদাহরণ হিসেবে সাদাকড়ই, শীলকড়ই, চট্টগ্রামকড়ই বা মটরকড়ই ইত্যাদি নাম বলা যেতে পারে। এই তালিকায় গগনশিরীষের নামও যুক্ত করা যায়। এদের মধ্যে রেইনট্রি বা মেঘশিরীষ আঞ্চলিকভাবে রেন্ডিকড়ই নামে পরিচিত।

অন্যান্য শিরীষের তুলনায় দেশে মেঘশিরীষই সংখ্যায় বেশি। এত সব শিরীষের ভিড়ে একটি গাছ শুধুই শিরীষ হিসেবে পরিচিত। এই শিরীষ মূলত সুগন্ধি ফুলের জন্য বিখ্যাত। প্রস্ফুটন মৌসুমে ফুলটির তীব্র গন্ধ অনেক দূর অবধি ছড়িয়ে পড়ে। গাছটি প্রায় সারা দেশে দেখা যায়। ঢাকায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো স্বল্প সংখ্যক উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে এই শিরীষ অন্যতম। অযত্নে বেড়ে ওঠা এই গাছ ঢাকায় একসময় সংখ্যায় অনেক ছিল। এখন কমেছে।

নিসর্গী ও বিজ্ঞান লেখক দ্বিজেন শর্মা তাঁর শ্যামলী নিসর্গ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শিরীষ ফুলের সৌন্দর্য সম্পর্কে এদেশীয় কবিকুলের সচেতনতা সুপ্রাচীন।’ কালিদাস শিরীষকে চারু কর্ণের অলংকার বলে মেঘদূতে (চারুকর্ণে শিরীষং) উল্লেখ করেছেন। বৈষ্ণব কবি রাধামোহনের কাছে শিরীষ কোমলতার প্রতীক, তাই লিখেছেন, ‘শিরীষ কুসুম জিনি কোমল পদতল।’ আর রবীন্দ্রনাথ তো প্রশংসায় অসম্ভব উচ্ছ্বসিত না হলে ফাল্গুনেই শিরীষের প্রস্ফুটনে এত ঐশ্বর্য খুঁজে পেতেন না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায় ফাগুন মাসে/ কী উচ্ছ্বাসে/ ক্লান্তিবিহীন ফুল ফোটানোর খেলা।’

চৈত্রের শেষ ভাগে দু-এক পশলা বৃষ্টি হলে শিরীষফুল ফুটতে শুরু করে। গ্রীষ্ম ছাড়িয়ে শরতের প্রায় শেষ ভাগেও কোনো কোনো গাছে ফুল থাকে। শীতে পাতা ঝরিয়ে উদোম হয়ে থাকা গাছে চওড়া ও লম্বাটে শিমের মতো ফলগুলো ঝুলতে থাকে। তখন মৃদু বাতাসে ঝনঝন শব্দ তোলে ফলগুলো।

পরিণত শিরীষ (Albizia lebbeck) মাঝারি আকারের বৃক্ষ। কাণ্ড সরল, উন্নত, গোলাকৃতি, দীর্ঘ, পাঁশুটে কিংবা সাদা এবং প্রায় মসৃণ। শীর্ষ ছত্রাকৃতি এবং সঘন পত্রবিন্যাসে ছায়ানিবিড়। পাতা দ্বিপক্ষল এবং আলোসংবেদী, তাই সন্ধ্যায় বুজে যায়। মঞ্জরির আকৃতি মেঘশিরীষের মতো হলেও আয়তনে বড়, রঙেও আলাদা। ফুলের সৌন্দর্য মূলত প্রস্ফুটিত পরাগ-কেশরেই দৃশ্যমান এবং সরু পাপড়ির কোমলতা পালকের সঙ্গে তুলনীয়। শিরীষ-মঞ্জরি হালকা হলুদ এবং পরাগকেশরের আগা সবুজ।

এ গাছের ছাল, পাতা, ফুল, বীজ ও কাঠের সারাংশ ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে। শরত্কালে ছাল, বসন্তে পাতা, বর্ষায় ফুল এবং বসন্তের প্রথম দিকে ওষুধের জন্য বীজ সংগ্রহ করতে হয়। বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফর্মুলারি ১৯৯২-এ ৭টি ওষুধ তৈরিতে শিরীষের ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। পাতার রস পরিমাপমতো খেলে এবং চোখে দিলে রাতকানা রোগ সেরে যায়। বীজচূর্ণ মিছরি, গরম দুধসহ সেবনে শারীরিক সক্ষমতা বাড়ে। চোখ ওঠা রোগে বীজের অঞ্জন ও পাতার রস বেশ উপকারী। ফুল বেটে পুড়ে যাওয়া স্থানে প্রলেপ দিলে ভালো হয়। বিষাক্ত কীট বা ইঁদুরের কামড়ে ক্ষতস্থানে ছাল বেটে লাগালে এবং ছালের রস পান করলে উপশম হয়। ছালচূর্ণ দিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত ও মাড়ি শক্ত হয়। শিরীষের শিকড় অরেচক, ছাল বিবিধ চর্মরোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার্য। শিরীষ কাঠ দৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী। শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও চীনেও গাছটি জন্মে।

  • মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক