সোনাদিয়ায় এসে গেছে পরিযায়ী পাখিরা

কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপপুঞ্জের আকাশে পরিযায়ী সৈকত পাখির ঝাঁকছবি: লেখক

দুজন বিদেশি পক্ষিবিদ—গ্যারি অলপোর্ট ও জ্যান-এরিক নিলসন, সম্প্রতি কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় ‘লেসার নডি’ নামের এক প্রজাতির সামুদ্রিক পাখি দেখেন, যা এ দেশের পক্ষিতালিকায় যুক্ত হলো। কাজেই পাখিটিকে দেখার প্রত্যয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে ‘বার্ডিংবিডি ট্যুরস’-এর সঙ্গে কক্সবাজার চলে গেলাম। ঘাটে নূরুল আফসারের স্পিডবোট তৈরিই ছিল। আমরা এলেই তা মহেশখালী চ্যানেলের দিকে ছুটল। ওখানেই জেলেদের মাছ ধরার ট্রলারগুলোর কাছে বয়ার ওপর পাখিগুলো বসে থাকে। কিন্তু বহুক্ষণ খুঁজেও দরিয়ার চিল ছাড়া অন্য কোনো পরিযায়ী পাখির দেখা পেলাম না। বেশ হতাশ হলাম। তবে সোনাদিয়ার বেলেকেরদিয়া চরেও ওদের দেখা গেছে। কাজেই বেলেকেরদিয়া ও কালাদিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সচরাচর সেপ্টেম্বরে পরিযায়ী পাখির খোঁজে এখানে আসি না। তবে এবার যেহেতু এসেছি, পরিযায়ী সৈকত পাখিগুলোরও খোঁজ নেব।

কালাদিয়া চরে যাওয়ার পথে তাজিয়াকাটায় মাছ ধরার জন্য পানিতে পোঁতা বাঁশের ওপর গোটা পঞ্চাশেক খোঁপাযুক্ত বৃহৎ গাঙচিল ও দরিয়ার চিল দেখলাম। ওদের ছবি তোলার পর দূর আকাশে একটি বড় গুলিন্দার দেখা পেলাম। এরপর উপকূলীয় বাদাবন পেরিয়ে কালাদিয়ার দিকে চললাম। চলার পথে একঝাঁক কালো-লেজ জৌরালির দেখা মিলল। সকাল ১০টায় কালাদিয়া পৌঁছলাম। ভাটা শুরু হয়ে গেছে। জোয়ারের পানি নামছে ধীরে ধীরে; নোলাজলের ভেতর থেকে উঁকি মারছে টুকরো টুকরো বালুচর। চরের কাছাকাছি এসে ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে দেখলাম, চার-পাঁচ শ সৈকত পাখির একটি ঝাঁক সদ্য জেগে ওঠা বালুচরে খাদ্যের সন্ধান করছে।

স্পিডবোট থেকে হাঁটুপানিতে নেমে ধীরে ধীরে পরিযায়ী পাখিগুলোর দিকে এগোতে থাকলাম। কিছুটা এগোচ্ছি আর থেমে থেমে ক্লিক করছি। পাখি ও আমাদের মধ্যে নিরাপদ দূরত্বসীমা অতিক্রম করামাত্রই ওরা উড়ে আকাশে চক্কর মেরে পাশের আরেকটি ক্ষুদ্র চরে গিয়ে বসল। এভাবে ঘণ্টাখানেক পাখির পেছনে ঘুরে বড় গুলিন্দা, ছোট গুলিন্দা, বড় জিরিয়া, ছোট ও বড় টিটি জিরিয়া, পীত পাথুরে বাটান, আদাকাইচে, ঠোঁটমোটা চাপাখি, গুলিন্দঠোঁটি চাপাখি, উল্টো চঞ্চু চাপাখি, বামন চাপাখি ও লালচে ঘাড় চাপাখিসহ ১০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা পেলাম। এরপর বেলেকেরদিয়ার উদ্দেশে রওনা হলাম।

বেলেকেরদিয়ার কাছাকাছি এসে খানিকটা দূরের একচিলতে চরে একঝাঁক পাখি দেখা গেল। অধ্যাপক মনিরুল খান চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে সেই ঝাঁকে কালচে একটি পাখি দেখলেন। যা বোঝার তা বুঝে ফেললাম। দ্রুত নূরুল আফসারকে সেদিকে স্পিডবোট ছোটাতে বললাম। কিন্তু বড় বড় ঢেউ ও ডুবোচরের ভয়ে সে যেতে চাইল না। অবশেষে তাকে বললাম যে পাখির খোঁজে সুদূর ঢাকা থেকে এসেছি, মনে হচ্ছে সেই পাখি এখানে আছে। এ কথায় কাজ হলো। সে স্পিডবোট চরের কাছাকাছি নিয়ে গেল। বোট থেকে হাঁটুপানিতে নেমে ধীরে ধীরে সামনে এগোতে থাকলাম। সত্যিই আমরা যার খোঁজে এসেছি, সেই অতি আরাধ্য সাদা-কপালের কালচে-বাদামি লেসার নডির দেখা মিলল। সবাই বেশ খুশি। দেড় ঘণ্টায় নানা ভঙ্গিমায় পাখিটির ছবি তোলা ও ভিডিও করা হলো। ওখানে বড় বদরকইতর, সাদা-ডানা গাঙচিল, ছোট ও বড় খোঁপাযুক্ত গাঙচিল, দরিয়ার চিল, মাঝারি গাঙচিলসহ আট প্রজাতির গঙ্গাকৈতর-গাঙচিলের দেখা পেলাম।

এরপর বেলেকেরদিয়া যাওয়ার পথে আরেকটি ছোট চরে চার প্রজাতির গাঙচিল ও বামন চাপাখি দেখলাম। তবে বেলেকেরদিয়া আমাদের হতাশ করল। ওখানে কোনো পাখিই পেলাম না। ফিরতি পথে উপকূলীয় বাদাবনের পাড়ে দুই প্রজাতির পরিযায়ী পাখির—লাল-পা পিউ ও ছোট টিটি জিরিয়ার দেখা পেলাম। কাজেই পুরো সোনাদিয়ায় ১৯ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি দেখা গেল। তবে বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন চামচঠুঁটি চাপাখি ও তিলা-সবুজ চাপাখি এবং সংকটাপন্ন ডোরালেজ জৌরালির দেখা পাইনি। যাহোক এখন পরিযায়ী পাখিরা মাত্র আসা শুরু করেছে। আশা করি, নভেম্বরের মধ্যে প্রায় সব প্রজাতি চলে আসবে। সংখ্যার হিসাবে পুরো সোনাদিয়ায় সর্বোচ্চ হাজারখানেক পাখি এসেছে। তবে সামনের দিনগুলোয় অনেক বেশি সংখ্যায় আসবে বলে আশা করছি।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখিবন্য প্রাণী প্রজনন চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ