অনন্তলতা ও অনন্তমূল

দুই রঙের অনন্তলতাছবি: লেখক

কয়েক দিন আগে আমরা ‘তরুপল্লব’ থেকে গাছ চেনানোর অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম গাজীপুরের শ্রীপুরে একটি শালবনে। বনের ভেতরে গাছগুলো দেখছিলেন অর্ধশতাধিক বৃক্ষপ্রেমী।

প্রতিটি গাছের পরিচয় জানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল সবাইকে। সতীর্থদের একজন গাছের ওপর একটি সুদৃশ্য লতা দেখিয়ে পরিচয় জানতে চাইলেন। বললাম, অনন্তমূল। খানিকটা এগিয়ে আবার সেই লতা দেখতে পেলাম আমরা। বোঝা গেল, এই বনে অনন্তমূলের অবস্থান সন্তোষজনক।

এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল; কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল তখনই, যখন দলের আরেকজন বৃক্ষবন্ধু বললেন, এটা তো মনে হয় অনন্তলতা। তাঁকে ভুল শুধরে দিয়ে বললাম, এটা অনন্তলতা নয়, অনন্তমূল। অনন্তলতা আর অনন্তমূল আলাদা দুটি উদ্ভিদ। আসলে এই ভুল অনেকেই করেন।

অনন্তলতা আর অনন্তমূল নিয়ে এমন বিভ্রান্তি থাকা উচিত নয়। যদিও এগুলো লতানো ধরনের উদ্ভিদ; কিন্তু একটির সঙ্গে অন্যটির মৌলিক কোনো সাদৃশ্য নেই; বরং বৈসাদৃশ্যই বেশি। কয়েক বছর আগে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো অনন্তলতার জৌলুশ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, কেউ শখ করে গাছগুলো লাগিয়েছেন। পরে বিস্তীর্ণ এলাকায় ফুলের রাজত্ব দেখে ভুল ভাঙে। অথচ আমাদের দেশে গাছটি রীতিমতো যত্ন করে লালন করতে হয়।

ঘনবদ্ধ এ ফুল দূর থেকে দেখতে অনেকটা মালার মতো। উদাহরণ হিসেবে মণিমালার (মিলেশিয়া) কথা বলা যেতে পারে। অনন্তলতার ফুলের গড়নও অনেকটা একই রকম। সাদা ও গোলাপি দুই রঙের ফুল যদি একসঙ্গে থাকে, তাহলে সেই সৌন্দর্য অসাধারণ এক বর্ণশোভা তৈরি করে। অনন্তলতা আমাদের রীতিবদ্ধ বাগানে খুব একটা চোখে পড়ে না। পতিত জায়গায় কিংবা ঝোপঝাড়ে অনায়াসে এই লতা বেড়ে উঠতে পারে। অনেকেই বাগানের শোভা বাড়ানোর জন্য এ ফুলের ‘আর্চ’ তৈরি করেন।

অনন্তমূল
ছবি: লেখক

আবার কোনো কোনো বাগানের প্রবেশপথেও এর নান্দনিক বিন্যাস চোখে পড়ে। লতানো স্বভাবের হওয়ায় বাহন পেলে অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। প্রস্ফুটন–প্রাচুর্য দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এই ফুল সব ধরনের বাগানেই আদর্শ। তা ছাড়া বিশেষ উদ্যানশৈলীর জন্য বিভিন্ন নকশায়ও এই গাছ উপস্থাপন করা যায়। অনন্তলতা ঢাকায় সায়েন্স ল্যাবরেটরি লাগোয়া সড়কদ্বীপ, ধানমন্ডি, কাকরাইল, বলধা গার্ডেন ও বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ বিভিন্ন পার্ক ও উদ্যানে মোটামুটি সহজলভ্য।

অনন্তলতা Antigonon Leptopus; গ্রামেও এই লতা মোটামুটি সহজলভ্য। গাছ লতানো, শিকড় ও কাণ্ড কোনাচে ধরনের, কিছুটা খাঁজকাটা। ফুল ফোটার প্রধান মৌসুম গ্রীষ্মকাল হলেও রেশ থাকে শীতের প্রথম ভাগ অবধি। অন্যান্য দেশে এর প্রকারভেদ থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণত সাদা ও গাঢ় লাল বা গোলাপি রঙের ফুল দেখা যায়। গোলাপি রঙের ফুলের বৃত্তাংশ চারটি ও রঙিন।

বংশবিস্তারে অনন্তলতার কৌশলের কমতি নেই। বীজগুলো জলে ভেসে চলে যায় দূরে—ডাঙায় পাখিতে খায়; হরিণ ও ছাগল–জাতীয় প্রাণীরও খাদ্য। খাবারের মাধ্যমে বীজ চলে যায় আরেক জায়গায়। গাছ ধ্বংস হয়ে গেলে; আগুন লেগে ছাই হয়ে গেলেও গাছের নিচের কন্দ আর সাকার-রুট (Succer Root) থেকে নতুন করে জন্ম হয় অক্ষয় অনন্তলতার।

প্রায় ৫ হাজার ৬০০ বছর আগের মেক্সিকোয় বাদুড়–অধ্যুষিত গুহায় পাওয়া গেছে অনন্তলতার বীজের অস্তিত্ব। এর বীজ থেকে তৈরি খই তখনকার জনজীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা ১৭০০ শতাব্দীর একটি পেইন্টিং থেকে বোঝা যায়। তাতে একজন পপকর্ন দেবতার মাথায় খইয়ের মুকুট দেখা যায়।

প্রসঙ্গত এখানে অনন্তমূলের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও আবশ্যক। আমাদের দেশে যে কয়টি সুখ্যাত ঔষধি গাছ আছে, তার মধ্যে অনন্তমূল অন্যতম। এ গাছের মূল, লতা ও পাতা নানান রোগের মহৌষধ। অনন্তমূল Hemidesmus indicus. দুধকষে ভরা কিছুটা প্যাঁচানো ধরনের লতা। পাতা সরু, লম্বাটে, ৫ মিলিমিটার লম্বা ও ঈষৎ সবুজ। ফুলে মঞ্জরি-ঢাকনা আছে। ফল লম্বাটে, ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার; জোড়ায় থাকে, প্রতিমুখী ও সরু। বীজ কালো। জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস ফুল ও ফলের মৌসুম।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক