বন সূর্যমুখীর দেখা পেলাম

মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ফুটেছে বন সূর্যমুখীছবি: লেখক

শীতের বেলা বলে কথা। দুপুরের পর দেখতে দেখতে রোদ ফুরিয়ে যায়। বিকেল ৪টা ৮ মিনিট। এরই মধ্যে মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে পাতলা কুয়াশা নামতে শুরু করেছে। পশ্চিমের শেষ রোদটুকু মেখে আছে লম্বা লম্বা গাছের মাথায়। রোদ নেই তো কি, গোলাপবাগানে হাজার হাজার গোলাপ ফুটে সে আলোর অভাব যেন পুষিয়ে দিচ্ছে।

ডানে ২ নম্বর গোলাপবাগান রেখে হাঁটছি, বাঁয়ে মৌসুমি ফুলের বাগান। সেকশন চুয়াল্লিশের সে বাগানে ৫২ জাতের মৌসুমি ফুলগাছ থাকার কথা লেখা আছে সাইনবোর্ডে। বাস্তবে অতগুলো না থাকলেও একটি ফুল দূর থেকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সূর্যমুখী ফুল হবে হয়তো, তেমনি পাপড়ির বিন্যাস ও রং।

কিন্তু পাতাগুলো যে ত্রিশূলের মতো, কিনারা গভীরভাবে খাঁজকাটা! সূর্যমুখীর পাতা কখনো এমন হয় না। কৌতূহল নিয়ে তাই সে গাছের কাছে গেলাম। সূর্যমুখীর এমন গাছ কখনো দেখিনি। সঙ্গে ছিলেন দুই প্রকৃতিসখা। তাঁরাও বললেন, এ গাছ কখনো দেখিনি। একজন মালি সে বাগানে কাজ করছিলেন। ভাবলাম এ ফুলের নামটা হয়তো তিনি জানতে পারেন। জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ও তো বন সূর্যমুখী, সিলেটের পাহাড়ি বনে হয়। এ নামে এ দেশে কোনো ফুল আছে কি না, তা মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না, মনে পড়ছে না। মালি জানালেন, তিন-চার বছর আগে এসব গাছ লাগানো হয়েছে। প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে। তার মানে বন সূর্যমুখীর গাছ বহুবর্ষজীবী।

বন সূর্যমুখীর গাছ দেখতে অনেকটা স্থলপদ্মের মতো, বেশ কয়েকটা গাছ সেখানে লাগানো। ছোটখাটো একটা ঝোপ হয়ে আছে। বেশ কয়েকটা গাছের গোড়া কাটা। কাটা গোড়ার কাণ্ডগুলো কাষ্ঠল ও মোটা, ধূসর বাদামি, খসখসে বাকল। কাটা গোড়াগুলো থেকে ডালপালা গজিয়েছে। ডালগুলো বেশ সরু ও লম্বা, শাখায়িত। ডালের মাথায় একটা একটা করে ফুল ফুটছে। ফুল শুঁকে পেলাম মধুর মতো ঘ্রাণ, অনেকটা শর্ষে ফুলের মতো। সূর্যমুখী গাছ বাঁচে মাত্র এক মৌসুম, শীতকালে লাগানো হয়, তেলবীজ ফসল হিসেবে এ দেশের মাঠে চাষ করা হয়।

একটি গাছে একটি মাত্র ফুলই ফোটে। কখনো কখনো সূর্যমুখী গাছের মাথা ভেঙে গেলে কয়েকটা ডাল বের হয়। তখন একাধিক ফুল ফোটে, সেসব ফুল হয় আকারে অনেক ছোট। কিন্তু বন সূর্যমুখী গাছে অনেকগুলো ফুল ফোটে। ফুল ঝরে গেলে লম্বা সরু পুষ্পবৃন্তের মাথায় গোলাকার ছোট বলের মতো নস্যি রঙের বীজাধার তৈরি হয়। সে বলের মধ্যে কদম ফুলের মতো খাড়া হয়ে বীজগুলো গেঁথে থাকে, দেখতে ললিপপের মতো। সূর্যমুখীর মতো চ্যাপটা থালাকৃতি বৃহৎ বীজাধার এর হয় না। এর বীজ থেকে তেলও হয় না।

ফুলগুলো সূর্যমুখী ফুলের মতো দেখতে হলেও তার সঙ্গে এ ফুলগুলোর বেশ পার্থক্য দেখলাম। সূর্যমুখীর ফুলের চেয়ে এ ফুল ছোট, পাপড়ির ব্যাস পাঁচ ইঞ্চির বেশি হবে না। সূর্যমুখী ফুলের পাপড়ির বিস্তার এক ফুট পর্যন্ত হতে পারে। সূর্যমুখী ফুলের কিনারা পাপড়িগুলো চক্রাকারে সূর্যরশ্মির মতো চারদিকে ছড়িয়ে থাকে। এ ফুলের পাপড়িগুলোও সেভাবে চক্রাকারে ছড়ানো। পাপড়ি মাত্র এক সারি, কিন্তু সূর্যমুখী ফুলের পাপড়ি থাকে কয়েক সারি। সূর্যমুখী ফুলের মাঝখানে চাকতিটি বেশ বড় ও চিতই পিঠার মতো বুকটা উঁচু, বীজাধার দেখতে খানিকটা চাকতির মতো। মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকা এ গাছের জন্মভূমি, তাই ওয়াইল্ড সান ফ্লাওয়ার বা বন সূর্যমুখীর আরেক ইংরেজি নাম মেক্সিকান সান ফ্লাওয়ার। মেক্সিকো ও আফ্রিকায় এ গাছ আগাছা, গাছ দ্রুত বাড়ে বলে সেসব দেশে এই আগাছা চাষ দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ও পচিয়ে মাটির উর্বরতা বাড়ানো হয়। শোভাবর্ধক গাছ হিসেবে বাগানে লাগানো হয় না।

সূর্যমুখী ও বন সূর্যমুখী দুটি একই গোত্রের গাছ হলেও প্রজাতি আলাদা। সূর্যমুখীর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Helianthus annuus এবং বন সূর্যমুখীর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Tithonia diversifolia, গোত্র অ্যাস্টারেসি। বন সূর্যমুখী কাষ্ঠল কাণ্ডবিশিষ্ট গুল্ম প্রকৃতির গাছ। গাছ ২ থেকে ৩ মিটার লম্বা হয়। গাছ মধ্যম খরা সইতে পারে। গাছের কাণ্ড শক্ত ও খাড়া, তবে ডালপালা কিছুটা নোয়ানো ও নরম। পাতা ৩ থেকে ৭টি গভীর খাঁজে খণ্ডিত, প্রতিটি খণ্ডের শীর্ষ তীক্ষ্ণ। বীজ থেকে ও ডাল কেটে লাগালে গাছ হয়। বাংলাদেশের উদ্ভিদ তালিকায়Tithonia diversifolia প্রজাতির গাছ নেই, আছে Tithonia tagetiflora, যার বাংলা নাম অরোরা।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক