কমলা-লাল বুকের বিরল নীলমণি
বিরল নাকতা হাঁসের মমি করা নিষ্প্রাণ দেহটি প্রথম দেখি লন্ডনের বিশ্বখ্যাত ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। তিন বছর পর ভারতের রাজস্থানের জয়পুর ও ভরতপুর এবং উত্তর প্রদেশের আগ্রায় সত্যিকারের হাঁসটিকে দেখলাম। তবে দুর্ভাগ্য, দেশের মাটিতে কখনোই পাখিটিকে দেখিনি। সে কারণে ২০২০ সালের ৮ মার্চ টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। রাতের বাসে উঠব, তাই সকালেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফেললাম। দুপুরের খাবারের পর টিভি অন করতেই আইইডিসিআরের ঘোষণায় দেশে প্রথম করোনা পজিটিভ রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানা গেল। বাসা থেকে প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হলাম। অনেক কষ্টে পরিবারকে বুঝিয়ে রাতের বাসে চাপলাম।
শেষ পর্যন্ত অতি আরাধ্য বিরল নাকতা হাঁসের ছবি তুলতে সক্ষম হলাম সফরের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ১০ মার্চ সকালে। এরপর সুনামগঞ্জ শহরে ফিরে এসে দুপুরের বাস ধরলাম হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে যাওয়ার জন্য। সাতছড়ি পৌঁছে দ্রুত দুপুরে খাবার সারলাম। তারপর ছুটলাম বনের গহিনে—পুণ্যি পুকুরের দিকে—বিরল ও দুর্লভ পাখির সন্ধানে।
মনোপডের ওপর ক্যামেরা বসিয়ে পুণ্যি পুকুরের পাড় ঘেঁষে ঝোপের মধ্যে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলাম। এখানে পাখিরা গোসল করতে আসে। তবে একটু শব্দ হলেই ভয়ে পালিয়ে যায়। তাই ছদ্মবেশী পোশাক পরে ঝোপের মধ্যে চুপচাপ বসে আছি। আমার চোখজোড়া যখন বাঁশঝাড়ের আড়ালে থাকা অন্য একটি পাখি খুঁজতে ব্যস্ত, ঠিক তখন নীরবে কমলা-লাল বুকের নীল পাখিটি পুণ্যি পুকুরপাড়ে নেমে গোসল করতে লাগল। হঠাৎই দৃষ্টি সেদিকে গেল। আর ওর লালচে-নীল দ্যুতিতে চোখ যেন ঝলসে গেল! ওর সৌন্দর্যে এতটাই বিমোহিত হলাম যে ছবি তোলায় মনোনিবেশ করতে পারলাম না। এরপর বারকয়েক সে পুণ্যি পুকুরে পুণ্যি¯স্নান সারতে নামল। আর আমিও মন ভরে ওর ছবি তুললাম।
করোনা মহামারির শুরুতে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের পুণ্যি পুকুরে দেখা নীল-কমলা পাখিটি এ দেশের এক বিরল ও অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি লালপেট নীলমণি। আলতা/আলতানীল/নীল/কমলা চটক নামেও ডাকা হয়। ইংরেজি নাম রুফাস-বেলিড নিলটাভা। মাসসিক্যাপিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম GNiltava sundara। পাখিটির মূল আবাস হিমালয় ও আশপাশের এলাকায়। শীতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পরিযায়ী হয়।
প্রাপ্তবয়স্ক লালপেট নীলমণির দৈর্ঘ্য ১৫ থেকে ১৬ সেন্টিমিটার। ওজন মাত্র ১৯ থেকে ২৪ গ্রাম। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে একেবারেই আলাদা। একনজরে পুরুষের পালক নীল-কমলা। মাথা-ঘাড়-গলা-পিঠসহ দেহের ওপরটা নীল। কপাল কালো। চিবুক ও গলা কালচে নীল। ডানা কালচে-ধূসর। বুক-পেট-লেজতল ও দেহের দুই পাশ লালচে-কমলা। ঠোঁট কালো। অন্যদিকে স্ত্রীর পিঠ ও দেহের নিচটা জলপাই-বাদামি। কপাল কমলা-পীতাভ, ডানা ও লেজ লালচে, থুতনি থেকে গলার ওপরের অংশ হলদে-জলপাই। গলায় রয়েছে সাদা পট্টি। ঠোঁট কালচে-বাদামি। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে চোখের মণি বাদামি। পা ও পায়ের পাতা গাঢ় ধূসর। ঘাড়ের দুই পাশে উজ্জ্বল নীল পট্টি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির গলায় রয়েছে ডিম্বাকার পট্টি।
শীতে সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন, বিশেষ করে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, আদমপুর সংরক্ষিত বন ও মাধবকুণ্ড ইকোপার্কে দেখা মেলে। পত্রবহুল বৃক্ষতলের লতাগুল্ম ও ঝোপে ঢাকা পাহাড়ি বনে ঘুরে বেড়ায়। সচরাচর বনের ছায়াময় ঝিরির কাছে একাকী বা জোড়ায় দেখা যায়। প্রধান খাদ্য পোকামাকড়; পাকা ও রসালো ফলেও আপত্তি নেই। মিষ্টি কণ্ঠে ‘জিফ-চা-চুক্—-’, ‘টর-র-র-ট্-চিক্—-’, বা ‘সিউইইইক্—-’ স্বরে ডাকে।
এপ্রিল থেকে আগস্ট প্রজননকাল। এ সময় মূল আবাস এলাকার পাহাড়ি ঢালের খোঁদলে, পাথরের খাঁজে, মাটিতে গাছের শিকড়বাকড়ের মধ্যে অথবা পড়ে থাকা মরা গাছের গুঁড়িতে ছোট কাপ আকারের বাসা বানায়। স্ত্রী ডিম পাড়ে ৩ থেকে ৪টি। ডিমের রং হালকা গোলাপি-সাদা; ডিমের ভোঁতা প্রান্তে ইট-লাল ঘন ছিট-ছোপে ভরা। স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে তা দেয়। ডিম ফোটে ১২ থেকে ১৩ দিনে। ছানারা প্রায় ১৭ দিনে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল প্রায় পাঁচ বছর।
লেখক: পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ