রূপে অনন্য শ্বেত বাসন্তী

পর্যাপ্ত পানি ও সূর্যের আলো পেলে শ্বেত বাসন্তী গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। ব্রহ্মপুত্রের তীরে কাছারিঘাটের এক নার্সারি থেকে তোলাছবি: লেখক

ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্রতীরের জয়নুল উদ্যানে হাঁটতে যাই প্রতিদিন ভোরে। উদ্যানের গাছপালা, পরিচিত মানুষের কুশল বিনিময়, ভোরের হাওয়া, ব্রহ্মপুত্রের ওপারের গ্রামের নিসর্গ মন ভালো করে দেয়। ফেরার পথে ব্রহ্মপুত্র তীরে কাছারিঘাটের এক নার্সারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় প্রতিদিনই ঢুঁ মেরে যাই সেখানে। গত ২০ এপ্রিল অনেক উদ্ভিদের ভিড়ে সেখানে পেয়ে গেলাম শ্বেত বাসন্তীর দেখা। দেখে মনে হলো, আকাশে অনেক তারা ফুটে আছে। ছবি তুলে ফেললাম ঝটপট।

 বহুবর্ষজীবী, কাষ্ঠল, ছোট গুল্মজাতীয় এই উদ্ভিদ ৬০-৮০ সেন্টিমিটার উঁচু হতে পারে। পাতা উজ্জ্বল সবুজ এবং ৮-১০ সেন্টিমিটার লম্বা কাষ্ঠল, ছোট গুল্মজাতীয়। পাতার কিনারা খাঁজকাটা, শিরাযুক্ত এবং দেখতে অনেকটা পাটপাতার মতো। পাতার নিচের পৃষ্ঠে পাতলা সাদা লোম থাকে। উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম Turnera subulata, এটি Passifloraceae পরিবারের। ঝুমকোলতাও এই পরিবারের সদস্য। এই গাছগুলোতে বসন্ত ও গ্রীষ্মে প্রচুর ফুল ফোটে। তবে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ায় প্রায় সারা বছর ফুল ফোটে।

এই উদ্ভিদের কাণ্ড শাখান্বিত হয়ে বড় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। শাখা বেশি লম্বা হয়ে গেলে উদ্ভিদের ডাল নুয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। পর্যাপ্ত পানি ও সূর্যালোক পেলে গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। ফুল সুন্দর, উজ্জ্বল, ব্যাস ৫ সেন্টিমিটার। পাপড়ি পাঁচটি উজ্জ্বল সাদা বা ক্রিম রঙের। এই বলয়ের সঙ্গে থাকে মধুগ্রন্থি। পাপড়ির গোড়া উজ্জ্বল হলুদ। পাপড়ির হলুদ গোড়ায় থাকে কালো দাগ। এই দাগগুলোর সঙ্গে থাকে মধুগ্রন্থি। পুংকেশর হলুদ রঙের এবং স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। ফুলের পাপড়ি খুব পাতলা। ফুলের জীবনকাল মাত্র ঘণ্টা পাঁচেকের। দুপুরে সূর্যের তীব্র আলোয় ফুল চুপসে যায়। অল্প সময়ের জন্য ফোটে বলে এই ফুলকে ব্যঙ্গ করে ব্যাংকারস ফ্লাওয়ার এবং পলিটিশিয়ানস ফ্লাওয়ার নামে ডাকা হয়।

এই প্রজাতিতে ফুলের দুটি রূপ রয়েছে—থ্রাম ও পিন। থ্রাম ফুলের গর্ভদণ্ড খাটো এবং ফুলের দলনলের মুখে অবস্থিত পরাগধানী থেকে বড় পরাগরেণু উৎপন্ন হয়। পিন ফুলের গর্ভদণ্ড লম্বা এবং দলনলের মধ্যে অবস্থিত পরাগধানী থেকে ছোট পরাগরেণু উৎপন্ন হয়।

ফুলগুলো স্বপরাগায়ন করতে পারে না, তাই যাতে ফুলগুলো কার্যকরভাবে পরাগায়ন করতে পারে, তাই গর্ভদণ্ডের দৈর্ঘ্যের এই ভিন্নতা। উভয় ফুলই কিন্তু একই পরিমাণ পরাগরেণু উৎপন্ন করে।

শ্বেত বাসন্তী গাছ
ছবি: লেখক

এই ফুলগুলো নিজস্ব উজ্জ্বল রঙের দ্বারা পাখি, মৌমাছি ও পোকামাকড়কে বাগানে আকৃষ্ট করে এবং এভাবে অন্য গাছপালাকেও পরাগায়নে সহায়তা করে। একবার পরাগায়ন হয়ে গেলে নিষেকের পর ফুলগুলো ছোট লোমযুক্ত ফল উৎপন্ন করে, যাতে বীজ থাকে। শ্বেত বাসন্তী গাছের বীজের বিস্তরণ ঘটে পিঁপড়ার মাধ্যমে। কারণ, এর বীজের ওপরে যে লিপিডসমৃদ্ধ উপাঙ্গ থাকে, তা পিঁপড়ার প্রিয় খাবার। পিঁপড়া এই খাদ্যবীজ তাদের ঘরে বহন করে নিয়ে যায়। এভাবে বীজ দূরে স্থানান্তরিত হয়। সেখান থেকে গজায় চারা।

শ্বেত বাসন্তীর আদি নিবাস মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকা। পরে এই উদ্ভিদ ছড়িয়ে পড়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও ফ্লোরিডায়। এখন আমাদের বাংলাদেশসহ অনেক দেশে উষ্ণ আবহাওয়ায় জন্মায় এই উদ্ভিদ। গাছগুলো বেশ বলিষ্ঠ এবং খুব অল্প যত্নেœ ভালো ফুল ফোটে বলে এখন খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাগানে এগুলো সীমানা বা হেজ উদ্ভিদ হিসেবে জন্মানো যেতে পারে। ঝুলন্ত টব বা ঝুড়িতেও এগুলোকে সুন্দরভাবে স্থাপন করা যায়, পাতাসহ শাখা চারদিকে সুন্দরভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই উদ্ভিদে নিয়মিত পানি দেওয়া প্রয়োজন। এ গাছ খরা, দুর্বল মাটি এবং চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ায় আংশিক সহনশীল। ডালপালা লম্বা হয়ে গেলে গাছ ছেঁটে দিতে হয়। বীজ ও কাণ্ডের মাধ্যমে এর বংশবিস্তার হয়।

ঠান্ডা লাগা, হৃদ্‌রোগ, চর্মরোগ, ঋতুস্রাবজনিত ব্যথা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং প্রদাহের চিকিৎসায় হোয়াইট বাটারকাপ বা শ্বেত বাসন্তীর ঔষধির ব্যবহার রয়েছে।

  • চয়ন বিকাশ ভদ্র, অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান প্রকৃতিবিষয়ক লেখক