গোলাপি রঙের কেও ফুল

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে ফুটেছে গোলাপি রঙের কেও ফুলছবি: লেখক

একসময় কেও ফুল সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। গাছ হয়তো অনেকবার চোখে পড়েছে; কিন্তু ফুল না থাকায় আলাদা করে বোঝার উপায় ছিল না। প্রায় এক দশক আগে শরতের শেষ দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীর লাগোয়া কেওগাছগুলোয় শুভ্র ফুলের প্রাচুর্য দেখে ফুলটি সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠি। ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখি, গাছের পাতা ও কাণ্ডের বিন্যাস বেশ শৈল্পিক। গাছটির লালচে মঞ্জরি ঢাকনার কোল থেকে বেরিয়ে আসা সাদা রঙের ফুলগুলো সেই সৌন্দর্য আরও হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। বর্ষার অঝোর জলধারায় স্নান সেরে নেওয়া পরিচ্ছন্ন পত্রপল্লবের ভেতর শুভ্রতা ছড়ানো কেও ফুল আমাদের মনে সত্যিই প্রশান্তি এনে দেয়।

শরৎ-হেমন্তের স্নিগ্ধতার ভেতর কেও ফুলের এই মায়া-মুগ্ধতাকে প্রকৃতির আশীর্বাদ হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়। এমন সুষম আঙ্গিক–বিন্যাস ও মাধুর্যমণ্ডিত বৈশিষ্ট্যের কারণে ইদানীং অনেকেই বাগানে রাখছেন গাছটি। তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। বুনো ফুল বলেই হয়তো অবহেলিত। বাগান বা গৃহপ্রাঙ্গণকে বৈচিত্র্যময় করে তুলতে গাছটির আরও ব্যাপক ব্যবহার প্রয়োজন। শরৎ-হেমন্তে আমাদের চারপাশে ফুলের সংখ্যা নিতান্তই কম। এ ক্ষেত্রে এই দুই ঋতুর পুষ্পসজ্জায় কেও ফুল বিবেচিত হতে পারে; কিন্তু এমন সুদর্শন একটি উদ্ভিদ নগর উদ্যানে প্রায় অনুপস্থিতই বলা যায়। কেও ফুল নিয়ে এতসব স্তুতিবাক্যও গাছটির সুনামের পক্ষে যথেষ্ট নয়!

কেও ফুল নিয়ে যখন এতটাই বিভোর আমি, তখন রূপকথার রাজ্যে দেখা কোনো এক মায়াবী ফুলের মতো অসাধারণ আরেকটি রূপে ধরা দিল কেও ফুল। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে কেও ফুলের লোভনীয় রং দেখে ফুলটির প্রতি পক্ষপাতিত্ব আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এমন চোখধাঁধানো রঙের কেও ফুল আর কখনো দেখিনি। একই পরিবারের গাছ হলেও আমাদের বনবাদাড়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কেও ফুলের সঙ্গে এ গাছের প্রধান পার্থক্য বর্ণগত। সাদামাটাভাবে যাকে দুধে আলতা রং হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। গাছটি ২০১৮ সালে এখানে রোপণ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক আশরাফুজ্জামান। তিনি এ গাছের কন্দমূল সংগ্রহ করেন থাইল্যান্ড থেকে। ২০১৯ সাল থেকে গাছে ফুল ফুটতে শুরু করে। এই উদ্যানে গিয়ে পাশাপাশি থাকা কেও ফুলের তিনটি রকমফের দেখার বিরল সুযোগ হলো।

গোলাপি কেও ফুল (Costus phyllocephalus) বহুবর্ষজীবী কন্দজ গাছ। পাতাগুলো সর্পিলভাবে সাজানো থাকে, সরল; খাপ নলাকার, বন্ধ এবং ৩ সেন্টিমিটার চওড়া। শাখার প্রান্তে সুদর্শন পাতার কোলে ফুলগুলো ফোটে। ফুলের পাপড়ির সংখ্যা ৩, গোড়ার দিকে গলার অংশটি সাদা রঙের। পুংকেশর দেখতে অনেকটা পাপড়ির মতো, প্রায় ৩ সেন্টিমিটার লম্বা। দুধসাদা রঙের সঙ্গে গোলাপি রঙের মিশেলে অপূর্ব এই ফুল।

আমাদের বনবাদাড়ে ফোটা সাধারণ কেও ফুল (Hellenia speciosa) বীরুৎ শ্রেণির বহুবর্ষজীবী গাছ, ৩ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে, সাধারণত শাখাহীন। কাণ্ডের নিচের দিকে কিছুটা কাষ্ঠল। পাতা বোঁটাহীন, ডিম্বাকৃতির। মঞ্জরির ঢাকনি উজ্জ্বল লাল রঙের। পাপড়ি সাদা। ইন্দো-মালয়েশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি ও অস্ট্রেলিয়ায় এ গাছ সহজলভ্য।

এ গাছের কন্দমূল, পাতা ও বীজ গিঁটব্যথা, অজীর্ণ, পেটফাঁপা ও কুকুরের কামড়ের প্রতিষেধক হিসেবে কাজে লাগে। অজীর্ণ, পেটফাঁপা ও বদহজমে কচি পাতা ও ডগা রান্না করে সবজি হিসেবে দিনে অন্তত একবার ভাতের সঙ্গে খেতে হয়। তা ছাড়া জ্বর, মাথাধরা, ক্ষুধামান্দ্য, প্রমেহ, কৃমির সমস্যা, অপুষ্টি, জন্মনিরোধ ও চর্মরোগেও এ গাছের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। জ্বর, সর্দি-কাশি ও মাথাধরায় এক থেকে দেড় চা-চামচ কন্দরস চার-পাঁচ চামচ পানিতে মিশিয়ে গরম করে প্রতিদিন সকাল-বিকাল দু-তিন দিন সেবন করলে আরোগ্য হয়। বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগে পরিমাণমতো কন্দরস বাহ্যিকভাবে ব্যবহারে সুফল পাওয়া যায়।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতিপরিবেশবিষয়ক লেখক