জয়সাগর দিঘির কথকতা
সিরাজগঞ্জ জেলার প্রাচীন এক দিঘি, নাম জয়সাগর। চারপাশ সবুজে ঘেরা। শীতের দিনগুলোতে দেখা যায় হরেক পাখির আনাগোনা। দিনের বেলায় দিঘির সবুজ পানিতে খেলা করে মৃদু বাতাস। সাঁঝের বেলায় আবার আরেক রূপ। সূর্য পাটে নামার আগে রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিয়ে যায় দিঘির পানিতে।
রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের নিমগাছী বাজার থেকে একটু পশ্চিমে গেলে চোখে পড়বে জয়সাগর দিঘি। যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খ ম রেজাউল করিম রায়গঞ্জ ইতিহাস সমাজ ও সংস্কৃতি বইয়ে লিখেছেন, রায়গঞ্জে ৫৮ একর জায়গাজুড়ে রয়েছে আয়তাকার এই দিঘি। এর দৈর্ঘ্য আধা কিলোমিটার, প্রস্থ তার কিছুটা কম।
জয়সাগর দিঘি নিয়ে নানা জনশ্রুতি রয়েছে। রয়েছে নানা ইতিহাস। শোনা যায়, প্রাচীন বাংলায় গৌড়ের অধিপতি ফিরোজ শাহর করদ রাজা ছিলেন অচ্যুত সেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল কমলাপুর। ফিরোজ শাহর ছেলে বাহাদুর শাহ অচ্যুত সেনের মেয়ে ভদ্রাবতীকে দেখে মুগ্ধ হন এবং বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু রাজা অচ্যুত সেন তাতে রাজি ছিলেন না।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কমলাপুর আক্রমণ করেন বাহাদুর শাহ। সেখান থেকে ভদ্রাবতীকে অপহরণ করে নিমগাছীর দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন রাজা অচ্যুত সেন তাঁর বাহিনী নিয়ে বাহাদুর শাহর ওপর পাল্টা হামলা করেন। ঐতিহাসিক নিমগাছী প্রান্তরে সেই যুদ্ধে বাহাদুর শাহ পরাজিত হন। এ বিজয়ের গৌরবের স্মৃতি ও পরকালের কল্যাণের জন্য অচ্যুত সেন নিমগাছীর কাছে একটি দিঘি খনন করেন। পরে সেটিই জয়সাগর নামে পরিচিত হয়।
এ নিয়ে ঐতিহাসিক নগেন্দ্রনাথ বসুর কিছুটা ভিন্নমত রয়েছে। তাঁর লেখা বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস বইয়ের বরাতে অধ্যাপক খ ম রেজাউল করিম বলেছেন, জয়সাগর দিঘি খনন করা হয় বিরাট রাজার কল্যাণে। অচ্যুত সেনই বিরাট রাজা। তিনি বিশাল রাজত্বের অধিকারী ছিলেন বলে তাঁকে এ নামে অভিহিত করা হতো। একটি কিংবদন্তি আছে, একবার নিজের বিরাটত্ব জাহির করার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের ১২ জন রাজাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সবাইকে হত্যা করেন বিরাট রাজা। তারপর নিজের পাপমোচনের জন্য জয়সাগর দিঘি খনন করেন।
তখন আরেকটি সমস্যা দেখা দেয়। দিঘি খনন করার পরও তাতে পানি উঠছিল না। তখন বিরাট রাজা স্বপ্নাদেশ পান, জয়কুমার নামের একজন রাজকুমার দিঘিতে বিল্বপত্র (বেলের পাতা) রেখে দিলে তাতে পানি উঠবে। রাজা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন জয়কুমার নামের এক রাজপুত্র এ পথ ধরেই তাঁর গন্তব্যে যাচ্ছেন। তখন তিনি জয়কুমারকে দিঘির বিষয়টি খুলে বলেন।
এরপর রাজপুত্র দিঘিতে নেমে কোদাল দিয়ে কোপ দিতেই পানিতে ভরে যায়। তবে জয়কুমার আর পাড়ে উঠতে পারেননি। তিনি দিঘির পানিতে ডুবে মারা যান। জয়কুমার সদ্য বিবাহিত ছিলেন। স্বামীকে হারিয়ে তাঁর স্ত্রী অভিশাপ দেন, এই দিঘির কারণে তিনি বিধবা হয়েছেন, তাই এর পানি যেন কারও কাজে না লাগে। কথিত আছে, অনেক দিন এই দিঘির পানি মানুষ ও গবাদিপশুর ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল। কালক্রমে এ ধারণা অবশ্য বদলে যায়।
নগেন্দ্রনাথ বসুর বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস বইয়ে আরেকটি জনশ্রুতির কথা উল্লেখ আছে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক রেজাউল করিম। সে অনুযায়ী, পাল আমলে এ অঞ্চলে জয়রাজা নামে একজন রাজা ছিলেন। সন্তান কামনায় এক সাধুর পরামর্শে বিশাল এক দিঘি খনন করেন। দিঘি খননের পর রাজার পুত্রসন্তান হয়। রাজা তাঁর নাম রাখেন জয়কুমার। আর তাঁর নামের সঙ্গে মিল রেখে দিঘির নাম রাখা হয় জয়সাগর।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগপর্যন্ত জয়সাগরের চারপাশে গভীর জঙ্গল ছিল। এ জঙ্গলে বাঘ, শূকরসহ নানা জীবজন্তুর বিচরণ ছিল বলে জানা যায়। পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের একজন শিক্ষক ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে নিমগাছী এলাকায় বেড়াতে গিয়ে নিজের চোখে বাঘকে শূকর শিকার করতে দেখেছিলেন বলে তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। দিঘির চারপাশে অসংখ্য বেলগাছ ছিল। এখনো দু-চারটি বেলগাছ দেখা যায়। স্থানীয়দের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘যার মাথায় আছে তেল, সে খাবে জয়সাগরের বেল।’
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তান সরকারের মৎস্য বিভাগ জয়সাগর দিঘি পরিষ্কার করে মাছ চাষের পরিকল্পনা নেয়। দেশ স্বাধীনের পর এ কার্যক্রম আরও জোরদার হয়। দিঘির চার পাড়ে গড়ে ওঠে মানুষের বসতি। একসময় গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন লিজ নিয়ে এখানে মাছ চাষ শুরু করেছিল। বর্তমানে সরকারিভাবে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
জয়সাগর দিঘি দেখতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ আসেন। শীতকালে নানা ধরনের পাখি ভিড় জমায় এখানে। ফলে এ সময় বেড়াতে আসা মানুষের সংখ্যাও বাড়ে। জয়সাগর দেখতে চাইলে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ভূঞাগাঁতী বাসস্ট্যান্ড নামতে হবে। সেখান থেকে অটোরিকশায় করে নিমগাছী বাজার হয়ে জয়সাগর দিঘিতে যাওয়া যাবে। ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে করেও যাওয়া যায় এই দিঘিতে।