সিইজিআইএসের পূর্বাভাস
ভাঙনের ঝুঁকিতে ১৮০০ হেক্টর জমি
গবেষণা সংস্থাটির পূর্বাভাস বলছে, দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১২ জেলায় নদীভাঙনে ঘরহারা হতে পারেন ১৮ হাজার মানুষ।
সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় ভাঙন শুরু হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে মাদারীপুর, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ।
২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ১৬টি মসজিদ, ৫টি হাটবাজারসহ বহু স্থাপনা বিলীন হতে পারে।
বন্যার পাশাপাশি অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙন হচ্ছে।
এ বছর ভরা বর্ষায়ও দেশে সেভাবে বন্যা হয়নি। ফলে অন্যান্য বছরের মতো এবার জুলাই-আগস্টে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলো নদীভাঙনের ভয়াবহ রূপ দেখেনি। তবে এরপরও এসব অঞ্চলকে ভাঙনের ঝুঁকিমুক্ত বলা যাচ্ছে না।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) পূর্বাভাস বলছে, এ বছর দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১২ জেলার ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হতে পারে। এ কারণে ফসলি জমির পাশাপাশি ঘরবাড়ি হারাতে পারেন প্রায় ১৮ হাজার মানুষ। এরই মধ্যে সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় ভাঙন শুরু হয়েছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা সিইজিআইএস মূলত যমুনা, গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার সম্ভাব্য ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে থাকে। এবার যমুনায় ১৪টি স্থানে, গঙ্গার ৭টি ও পদ্মার ১টি স্থানে ভাঙন বেশি হতে পারে বলে তারা অনুমান করছে। ভাঙন ঠেকানোর উদ্যোগ নিতে ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সংস্থাটি তাদের গবেষণালব্ধ তথ্য সরকারকে দিয়ে থাকে। বেসরকারি সংস্থাগুলোও সংস্থাটির তথ্য ব্যবহার করে সম্পদ ও জীবনের ক্ষতি মোকাবিলায় উদ্যোগ নেয়।
‘আমরা নিয়মিত ভাঙনের সম্ভাব্য শিকার এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সরকারকে তথ্য দিই। সরকার থেকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়।ফিদা আবদুল্লাহ খান, সিইজিআইএসের নির্বাহী পরিচালক মালিক
ভাঙনের কারণ হিসেবে সংস্থাটি বন্যার পানির স্রোত ও নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলাকে দায়ী করেছে। মূলত বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় নদীতীরবর্তী যেসব এলাকার মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি থাকে, সেসব এলাকায় ভাঙন বেশি হয়। পদ্মা ও যমুনার তীরে এ ধরনের মাটি বেশি থাকায় ভাঙনও বেশি হচ্ছে।
জানতে চাইলে সিইজিআইএসের নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত ভাঙনের সম্ভাব্য শিকার এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সরকারকে তথ্য দিই। সরকার থেকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু দেশের অনেক এলাকায় অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে হঠাৎ ভাঙন বেড়ে যায়। তাই যথাযথ বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার ভিত্তিতে কোন এলাকা থেকে কী পরিমাণে বালু উত্তোলন করা যাবে, তার একটি কঠোর নিয়ম থাকা উচিত।’
ভাঙনের ঝুঁকিতে যেসব জেলা
সিইজিআইএসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এবার দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভাঙন বেশি হবে। জেলাগুলো হলো কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, রাজশাহী, ফরিদপুর ও মাদারীপুর। এসব জেলার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে ১৬৫ হেক্টরে মানুষের বসতি আছে। এ ছাড়া ২ হাজার ৭৯০ মিটার বেড়িবাঁধ, ২ হাজার ২৬৫ মিটার সড়কপথ ভাঙনের কবলে পড়তে পারে। এর মধ্যে জেলা, উপজেলা ও গ্রামীণ সড়ক রয়েছে।
এরই মধ্যে সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় ভাঙন শুরু হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে ভাঙন বাড়তে পারে। টাঙ্গাইলের নাগরপুর, সদর; রাজশাহীর চারঘাট, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, মাদারীপুরের শিবচর ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় দ্রুত ভাঙন সৃষ্টি হতে পারে।সুদীপ্ত হোড়, ভাঙনের এই পূর্বাভাস তৈরিতে করা গবেষণা দলটির প্রধান
ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে ২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন, ১৬টি মসজিদ ও ৫টি হাটবাজার, ২টি কবরস্থান, ২টি বেসরকারি সংস্থার কার্যালয়, এতিমখানা, বাসস্ট্যান্ড ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে মাদারীপুরের ৫১৫ হেক্টর, কুষ্টিয়ার ২১৫ হেক্টর এবং টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের প্রায় ২০০ হেক্টর এলাকায়।
পূর্বাভাস অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হতে পারে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার বাগুটিয়া ইউনিয়নে। সেখানকার ১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও অন্যান্য অবকাঠামো ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চৌহালি পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চৌবাড়িয়া শিকদারপাড়া টেকনিক্যাল ও ম্যানেজমেন্ট কলেজ, চৌবাড়িয়া শিকদারপাড়া এতিমখানা, চর সলিমাবাদ হাফিজিয়া মাদ্রাসা, চর সলিমাবাদ বাজার, পইলা বহুমুখী হাইস্কুল। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জের উলিপুর কেন্দ্রীয় বাজার, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আরডিআরএসের কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীভাঙনের কবলে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে।
ভাঙনের এই পূর্বাভাস তৈরিতে করা গবেষণা দলটির প্রধান সুদীপ্ত হোড় প্রথম আলোকে বলেন, এরই মধ্যে সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় ভাঙন শুরু হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে ভাঙন বাড়তে পারে। টাঙ্গাইলের নাগরপুর, সদর; রাজশাহীর চারঘাট, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, মাদারীপুরের শিবচর ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় দ্রুত ভাঙন সৃষ্টি হতে পারে।
হাওরাঞ্চল ছাড়া দেশের অন্য কোথাও এবার এখনো তেমন বন্যা হয়নি।আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী
প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে
গবেষণা সংস্থা সিইজিআইএস ২০০৪ সাল থেকে ভাঙনের পূর্বাভাস দিয়ে আসছে। ২০২২ সালের প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, ১৮ বছর ধরে তারা ভাঙনের যে পূর্বাভাস দিয়ে আসছে, তার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে দেশে নদীভাঙন রোধে সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগের কারণে ভাঙনের পরিমাণ নিয়মিতভাবে কমে আসছে।
২০২১ সালে সংস্থাটি ২ হাজার ৮০০ হেক্টর জমি ভাঙনের কবলে পড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল। এ পূর্বাভাস দেওয়ার পর পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসন থেকে ভাঙন রোধে নানা ধরনের প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়।
এতে পূর্বাভাসের চেয়ে ১ হাজার ৩০০ হেক্টর কম জমি ভাঙনে বিলীন হয়। তবে নদীতীরবর্তী এলাকার বাইরেও মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের ৪০০ হেক্টর চর ভাঙনে পড়ে। সেখানেও মানুষের বসতিসহ নানা অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল।
গত বছর গঙ্গা অববাহিকায় পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি এলাকায় নদীভাঙন হয়। আর যমুনায় পূর্বাভাসের অর্ধেকেরও কম এলাকা ভাঙে। গঙ্গায় পূর্বাভাসের চেয়ে সামান্য বেশি এলাকায় ভাঙন হয়েছিল।
জানতে চাইলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, হাওরাঞ্চল ছাড়া দেশের অন্য কোথাও এবার এখনো তেমন বন্যা হয়নি।
তাই জুলাই-আগস্টে সাধারণভাবে যেসব এলাকায় ভাঙন হয়, এবার তা হয়নি। তবে এ বছর সেপ্টেম্বর মাসের বাকি সময় ভাঙনের আশঙ্কা আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সম্ভাব্য ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলোতে প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে।