পঞ্চরূপে অলকানন্দা

নানা রূপের অলকানন্দা ফুল ফুটেছে খুলনার বয়রায় মালঞ্চ পুষ্প কেন্দ্র নার্সারিতেছবি: লেখক

কে রেখেছে এ ফুলের নাম অলকানন্দা? অলকানন্দা তো ভারতের উত্তরাখন্ডের একটি পবিত্র নদীর নাম। হিমালয়ের সতপন্থ ও ভগীরথ খড়ক হিমবাহ থেকে উৎসারিত এ নদী আবার গঙ্গা নদীর উৎস জলস্রোত। গিরিখাতের মধ্য দিয়ে প্রবল বেগে নির্ঝরের নূপূর বাজিয়ে নিরবধি বয়ে চলেছে সে নদী। বদ্রিনাথের কাছে মানা গ্রামে সেই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে শোনা গভীর গিরিখাতের স্রোতধ্বনি হৃদয়কেও আলোড়িত করে।

এই অলকানন্দার সঙ্গে পালাক্রমে যুক্ত হয়েছে আরও পাঁচটি উপনদী—ধৌলিগঙ্গা, নন্দাকিনী, পিন্ডার, মন্দাকিনী ও ভাগীরথী। শেষ উপনদী ভাগীরথী দেবপ্রয়াগে এসে গঙ্গা নামে পরিচিত হয়েছে। উত্তরাখন্ডে গিয়ে অলকানন্দার এই পাঁচ রূপের দেখা পেয়ে চমৎকৃত হয়েছিলাম।

আর এই বর্ষা শেষে অলকানন্দা ফুলের পঞ্চরূপ দেখে মুগ্ধ হলাম খুলনার বয়রায় মালঞ্চ পুষ্প কেন্দ্র নার্সারিতে গিয়ে। নার্সারির সামনের সীমানাবেড়ায় বৃষ্টি-বাতাসে পাঁচ রকমের অলকানন্দা গাছেরা তাদের ডালগুলো দুলিয়ে দুলিয়ে যেন বৃষ্টিবন্দনায় মেতে উঠেছে!

গোলাপি অলকানন্দা
ছবি: লেখক

অলকানন্দা ফুলগুলো বর্ষা-শরতে অলকানন্দা নদীর চেয়ে হৃদয়কে কম আন্দোলিত করে না। সারা বছর ধরে কিছু ফুল ফুটলেও আসলে বর্ষার জল পেয়ে ফুলগুলোও যেন অলকানন্দা নদীর মতো স্রোতবতী হয়ে ওঠে। হলদে ঘণ্টা বা মাইকের চোঙের মতো ফুলের স্রোত যেন বয়ে যায় উজ্জ্বল চকচকে সবুজ লতাপাতার শাখায় শাখায়। লতিয়ে যেখানে এ গাছ ওঠে, সে জায়গাটাকে আলো করে ফেলে ফুলগুলো।

বহুদিন ধরে অলকানন্দার এই মায়াবতী কাঞ্চন হরিদ্রা রূপই দেখে এসেছি। ফুলগুলো বেশ বড়, পাঁচ পাপড়ির। গাছ লতানো প্রকৃতির হলেও খুব বেশি দূর লতায় না; বরং লতাগুলো ঝোপ তৈরি করে থাকতেই যেন বেশি পছন্দ করে। এরপর চোখে পড়ল তুলনামূলকভাবে ছোট আকারের উজ্জ্বল শর্ষে হলুদ রঙের আরেক জাতের অলকানন্দা ফুলের। এত দিন এক সারির পাপড়ির অলকানন্দাই দেখে এসেছি। কিন্তু এ ফুলগুলোর পাপড়ি একাধিক সারিতে সাজানো। সচরাচর যেরূপ ছড়ানো পাপড়ির অলকানন্দা ফুল দেখা যায়,Ñএগুলো ঠিক তেমন নয়।

সম্প্রতি জাত উদ্ভাবকদের কল্যাণে এখন আরও বেশ কিছু নতুন জাতের বিদেশিনী অলকানন্দা দেখা যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে হালকা গেরুয়া বা ঘিয়ে রঙের ফুলগুলো বেশ বড়, ফোটেও প্রচুর। ফুল দেখে কখনো কখনো ওকে কনকসুধা ফুলের মতো মনে হয়। কিন্তু পাতা আর গাছ ভালো করে খেয়াল করলে সে তফাত ধরা পড়ে।

আরেক জাতের অলকানন্দা চোখে পড়ল, যে ফুলের রং বেগুনি আভায় গোলাপি। তবে একেবারেই মেরুন রঙের ফুল, এটা সচরাচর দেখা যায় না। সেটার দেখাও পেলাম। সেই রাঙা অলকানন্দা ফুলের সুরধ্বনি যেন শুনতে পাই নজরুলের গানে—‘প্রাণের তটে কামোদে–নটে সুরে/ বাজিছে সুমধুরে।/ দুলে অলকানন্দা রাঙা তরঙে,/ শিখী, কুরঙ্গী নাচে রঙ্গীলা ভ্রূভঙ্গে/ বাজিছে বুকে কাফির সঙ্গে সুর-সারং॥’