এক টুকরা করচের বন

জল-ঝড়ের সঙ্গে যুগযুগের ভালোবাসায় এভাবেই টিকে আছে করচের গাছ। রাজনগরের কাউয়াদীঘি হাওরপারে
ছবি: প্রথম আলো

কাউয়াদীঘি হাওরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা অন্তেহরি যেন এক আদুরে কন্যারই নাম। গ্রামটির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তজুড়ে কত রকমের জলজ গাছ। হিজল-করচ, জারুল-বরুণ—কত কিছু। গাছে গাছে ফুল ফুটলে, পাখি আসর জমালে গ্রামটি তখন প্রাণ-প্রকৃতির এক সরব সত্তা হয়ে ওঠে। সেই গ্রামেরই এক পাশে এক টুকরা করচের বন রয়েছে। বনের গাছগুলো বর্ষার জলে গা ডুবিয়ে হয়ে ওঠে জলার বন। শীতেও গাছে গাছে সবুজ মায়ার কমতি নেই।

সেই কোন অজানা সময় থেকে অনেক পড়শির সঙ্গে ঝাড়ে-বংশে এখানে শিকড় ছড়িয়েছিল এই করচগাছগুলো। সেই থেকে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের অন্তেহরি গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে করচ বনটি হাওরপারের চেনা প্রকৃতির ঐতিহ্য হয়ে আছে।

হাওরের সঙ্গেই এই গ্রামের মানুষ যুগ যুগের বোঝাপড়া করে চলছে। জীবন-জীবিকার সম্পর্ক তৈরি করেছে। কখনো ধান-ফসলের সঙ্গে, কখনো জল-মাছের সঙ্গে। বর্ষায় হাওরের অথই জল এসে ভিটেবাড়ি ছুঁয়ে ঢেউ খেলে যায়। পথঘাট ডুবে যায়। জলে ভাসা গ্রামের মানুষ এই জল-প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে সংসার করে। শুকনা মৌসুমে পানি নেমে গেলে হাওরের বুকজুড়ে জেগে ওঠে আরেক মায়া। কোথাও ধানের সবুজ। কোথাও ঘাসের। ঘাসের বুকে চরে বেড়ায় গরু-মোষের পাল। যেদিকে চোখ যায়, খোলা দিগন্তে ঝিলমিল করা রোদ। পাড়ে পাড়ে হিজল-করচ, বরুণ, জারুল আর জলাভূমির নানা রকম বুনো গাছ রোদ পোহায়, রাতে কুয়াশায় ভেজে।

হাওরের চারপাশে আগের মতো অনেক জলজ গাছ আর নেই। জলা বন নেই। তবু এই হারানোর ভেতরেও যা কিছু ছিটেফোঁটা আছে, এখানে-ওখানে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে। তার একটি তো এই করচের বন। করচ মাঝারি আকারের বহুবর্ষজীবী ঘন ডালপালাসমৃদ্ধ একটি চিরসবুজ উদ্ভিদ। দেখতে অনেকটা বটগাছের মতো। গ্রীষ্মে ছোট ছোট থোকায় লালচে বা হালকা বেগুনি রঙের ফুল ফোটে।

এই করচ বনেই একদিন বিকেলে অন্তেহরি গ্রামের প্রেমানন্দ দাসের (৬০) সঙ্গে দেখা। তখন শেষ বিকেলের আলো পড়েছে বনে। করচগাছ, খোলা প্রান্তরের ঘাস—সবখানে আগুনরঙা নরম আলো ছড়ানো। এই লোক জানান, সেই ছোটকাল থেকে করচ বনটিকে তিনি একই রকম দেখে আসছেন। অন্তত দুই প্রজন্মের কথা তিনি বলতে পারেন। যাঁরা এই গাছগুলোকে দেখে বড় হয়েছেন, জীবন কাটিয়েছেন। সেদিক থেকে এই করচ বনের বয়স ১০০ বছরের কম হবে না। এই গাছের শুকনা ডালপালা গ্রামের মানুষের জ্বালানির জোগান দিয়ে চলছে। গ্রামকে ঝড়ঝাপটা থেকে রক্ষা করছে। ডালপালা কেটে নিলেও সব সইতে পারে তারা। গোড়া থেকে আবার গজিয়ে ওঠে গাছ, শাখা-প্রশাখা। বর্ষাকালে গাছের বেশির ভাগ শরীর পানির নিচে থাকে। গ্রাম আগলে এক টুকরা জলার বন হয়ে ওঠে স্থানটি। পানি সরে গেলে গাছ যা ছিল, তা-ই থাকে। একটি গাছও মারা যায় না।

করচ বনটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, গলাগলি করে দাঁড়ানো প্রায় অর্ধশত গাছ। গাছের শরীরজুড়ে কত রকমের ক্ষত, কাটা-চেরা, গর্ত। তবু কালের আনন্দ-বেদনাকে বুকে নিয়ে খাড়া হয়ে আছে তারা।

ফেটে যাওয়া চৌচির শরীরে বহু বছরকে ধারণ করার সাহস, উদাসীনতা আর ঘাত-প্রতিঘাত যেন ফুটে আছে। চিরসবুজ উদ্ভিদ বলেই শীতেও গাছের ডালপালা থেকে সব পাতাই ঝরে যায় না। কিছু ডালপালা শুকিয়ে গেছে মনে হলেও এগুলো মরে যায় না। বৃষ্টি হলেই ডালে ডালে পাতাগুলো হেসে ওঠে। পাতায় ফোটে হাওয়ার ঝিরিঝিরি গান।

সন্ধ্যার আকাশে করচ বনের ওপর দিয়ে সাদা বক ও পানকৌড়ির ঝাঁক গ্রামে ফিরতে থাকে। এ এক চিরকালীন ছবি। এগুলো সারা দিন হাওরের বিল-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, খাবার খোঁজে। ডানায় সাদা ঢেউ তুলে এক বিল থেকে আরেক বিলে উড়ে যায়। দিনান্তে ফেরে করচের বনে।