২০০৮ বা ২০০৯ সালের দিকে বাঁশপাতাগাছ প্রথম দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবরিকালচারের অফিস ঘরের সামনে। গাছটি লাগিয়েছিলেন আরবরিকালচার সেন্টারের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ হাদিউজ্জামান।
তখনো এ গাছ সম্পর্কে বিশদ জানা ছিল না। এ কারণে গাছটির সঠিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারিনি। দীর্ঘদিন প্রায় ভুলেই ছিলাম গাছটির কথা।
২০১৫ সালে ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে দ্বিতীয়বারের মতো গাছটি দেখার সুযোগ হয়। সেখানে দুটি পরিণত মাতৃগাছ রয়েছে। পরে অবশ্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনেও দেখেছি। বাঁশপাতা মূলত প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো দেশি প্রজাতির নগ্নবীজী উদ্ভিদের একমাত্র নরম কাঠের কনিফার বা মোচা আকৃতির ফলের পেনসিল কাঠের গাছ।
একসময় প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো বাঁশপাতাগাছ চট্টগ্রাম, রাঙামাটির পাবলাখালী, বাঘাইছড়ির কাসালং ও মাসালং, কক্সবাজারের উখিয়া এবং শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া বনাঞ্চলে পাওয়া যেত। বর্তমানে এ গাছ খুবই দুষ্প্রাপ্য।
২০১৭ সালে আরণ্যক ফাউন্ডেশন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপন্ন প্রজাতির বৃক্ষ পরিচিতি গ্রন্থের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ছাড়া শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া বনাঞ্চলে একটি এবং সারা দেশে প্রাকৃতিকভাবে ও লাগানো বাঁশপাতার মোট ১১১টি গাছ রয়েছে। এর মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছ রয়েছে মাত্র ১২টি এবং বাকি ৯৯টি লাগানো গাছ, যা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে আছে।
বাঁশপাতা বর্তমানে (Podocarpus neriifolius) বিপদাপন্ন প্রজাতির একটি বিরল গাছ। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএনের ২০১০ সালের লাল তালিকা অনুসারে বাংলাদেশে বাঁশপাতা মহাবিপদাপন্ন প্রজাতির একটি বিরল বৃক্ষ এবং বৈশ্বিকভাবে অন্যতম বিপদগ্রস্ত উদ্ভিদ হিসেবে অভিহিত। ২০১২ সালে প্রণীত দেশের বন্য প্রাণী আইনেও বাঁশপাতাগাছ সংরক্ষিত উদ্ভিদ হিসেবে অভিহিত।
বাঁশপাতা বড় আকৃতির চিরসবুজ বৃক্ষ, উচ্চতায় সর্বোচ্চ ৪০ মিটার এবং বুকসমান উচ্চতায় গুঁড়ি–কাণ্ডের বেড় ৬০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। পাতা বোঁটাহীন, পুরু, বল্লমাকৃতি, লম্বায় ১২ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার এবং চওড়ায় প্রায় সোয়া সেন্টিমিটার, কিনারা মসৃণ এবং আগা সুচাল। সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে এদের ভিন্ন ভিন্ন গাছে পুরুষ ফুল ও স্ত্রী ফুল ফোটে।
কখনো কখনো বছরে দুবারও ফুল ফুটতে দেখা যায়। বাঁশপাতার নগ্নবীজগুলো লম্বায় ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার এবং দেখতে অনেকটা কাজুবাদামের ফলের মতো। নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে বীজগুলো পরিপক্ব হয়ে আসে। তখন দেখতে উজ্জ্বল কমলা-লাল থেকে কালো রঙের হয়। প্রতি কেজি ফলে বীজের সংখ্যা ৪৫০ থেকে ৫০০টি। সাধারণ তাপমাত্রায় পাঁচ থেকে সাত দিন পর্যন্ত বীজ সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
বাঁশপাতার কাঠ হালকা বাদামি রঙের, নরম, কম মজবুত ও কম টেকসই। আসবাব, ক্যাবিনেট তৈরি, কাঠ–পেনসিল, ছবি বাঁধাইয়ের ফ্রেম, হারমোনিয়ামসহ বাদ্যযন্ত্রের সরঞ্জামাদি, পরিমাপের স্কেল, শো–পিস, কাগজ তৈরির মণ্ড, নৌকাÑইত্যাদি তৈরিতে এ কাঠ ব্যবহার্য। ফলের মাংসল স্ফীত অংশ খাওয়া যায়। পাতার রস বাত, গিঁটবাত এবং ঠান্ডাজনিত রোগে কাজে লাগে। বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে আলংকারিক উদ্ভিদ হিসেবে এ গাছ লাগানো হয়।
বনাঞ্চলে সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে বীজ থেকে এ গাছের চারা জন্মে ও বংশবৃদ্ধি ঘটে। তবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তা ব্যাহত হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশগত কারণে বীজের পরিমাণও কম হতে পারে।
এ কারণে বর্তমানে কাটিং বা কলম পদ্ধতিতে চারা তৈরি করা হচ্ছে। বাঁশপাতাগাছ বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, ফিলিপাইন, পাপুয়া নিউগিনি, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ও ফিজির স্থানীয় উদ্ভিদ।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক