তিন কারণে এ সময়ে এত বেশি বৃষ্টি
ভারী বৃষ্টি রাজশাহী ভাসিয়ে এবার ময়মনসিংহের দিকে গেছে। দেশের হাওরপ্রধান এ বিভাগের বেশির ভাগ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় মোট বৃষ্টি ৩৫০ মিলিমিটার ছাড়িয়ে গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে আজ শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত এই বিভাগে মোট বৃষ্টি হয়েছে ৩৭৮ মিলিমিটার। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, স্বাধীনতার পর ময়মনসিংহে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টি।
গতকাল রাজধানীর আকাশ ছিল ঘন কালো মেঘে ঢাকা। দুপুরের দিকে শুরু হওয়া বৃষ্টি আজ ভোর পর্যন্ত চলেছে। সকালের দিকে একটু বিরতি দিয়ে দুপুর থেকে ঢাকায় আজ বৃষ্টি বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এদিকে আবহাওয়া গবেষকেরা বলছেন, মূলত তিন কারণে বর্ষার শেষে এসে বৃষ্টি এত বেড়ে গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকে। তাই এ সময় পর্যন্ত বর্ষাকাল ধরা হয়।
আবহাওয়া গবেষকেরা এ সময়ে এত বৃষ্টির জন্য যেসব কারণের কথা বলছেন, তার প্রথমটি হলো, দেশের স্থলভাগে বর্তমানে দুটি স্থানে নিম্নচাপ একত্র হয়ে প্রচুর জলীয় বাষ্প ও বাতাস টেনে নিয়ে আসছে। দ্বিতীয়ত, বঙ্গোপসাগরে ভারত মহাসাগর দ্বিচক্র—আইওডি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তৃতীয়ত, মৌসুমি বায়ু বিদায় নেওয়ার সময়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে বিপুল পরিমাণে মেঘ জড়ো করছে।
ওই তিন কারণ সাধারণত বাংলাদেশের ভেতরে এই সময়ে একত্র হয় না। এবার বর্ষার শেষ সময়ে এসে তা হওয়ার কারণেই অল্প সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, মৌসুমি বায়ুর বিদায়বেলায় সাধারণত বৃষ্টি বেড়ে যায়। এবার স্থলনিম্নচাপ এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় বৃষ্টি বেড়ে গেছে। আজ দুপুর থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি বাড়তে পারে। তবে ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগে বৃষ্টি বেশি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, প্রথমত, চলতি মাসের শুরুতে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে একই সময় দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছিল। নিম্নচাপ দুটি দ্রুত স্থলভাগে উঠে পড়ে। আরব সাগরেরটি মুম্বাই দিয়ে এবং বঙ্গোপসাগরেরটি পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে স্থলভাগে উঠে যায়। পরে দুটি একত্র হয়ে গতকাল ভারতের সিকিম হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে রাজশাহীতে ঢোকে। আর তাই গতকাল রাজশাহীতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। গতকাল এটি আরও শক্তিশালী হয়ে ময়মনসিংহ হয়ে কিশোরগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে সিলেটের দিকে এগোয়। এ কারণে আজ ও আগামীকাল ওই এলাকায় বেশি বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।
দ্বিতীয়ত, ভারত মহাসাগরে এরই মধ্যে ভারত মহাসাগর দ্বিচক্র বা ইন্ডিয়ান ওশেন ডাইপল—আইওডি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি সক্রিয় হলে সাগরের মাঝখানের অংশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এতে জলীয় বাষ্প বেড়ে যায়, যা একজোট হয়ে ভূখণ্ডের দিকে আসতে থাকে। দুই মাস ধরে আইওডি সক্রিয় থাকায় ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প আসা বেড়ে গেছে। একই কারণে বঙ্গোপসাগর থেকে জেট স্ট্রিম বা ঘূর্ণিবায়ু তরঙ্গ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ওই বায়ু বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প ও বাতাস বাংলাদেশের দিকে নিয়ে আসছে।ফলে এখানে বৃষ্টি বেড়ে গেছে। গত আগস্টে চট্টগ্রাম ও রাঙামাটিতে এবং সেপ্টেম্বরে ঢাকায় একই কারণে অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছিল।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশ থেকে মৌসুমি বায়ু বিদায় নিতে শুরু করেছে। মৌসুমি বায়ুর অগ্রভাগ এবং পশ্চাদ্ভাগে জলীয় বাষ্প এবং মেঘ বেশি থাকে। ফলে জুনের মাঝামাঝি সময়ে এটি যখন টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তখন প্রচুর বৃষ্টি হয়। আর উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে যখন বাংলাদেশ ছেড়ে যায়, তখনো প্রচুর বৃষ্টি ঝরায়। সাধারণত অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তা বাংলাদেশ ভূখণ্ড ছেড়ে যায়। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে আসা নিম্নচাপের কারণে এটি এবার শেষ সময়ে এসে আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যে কারণে বাংলাদেশের ভেতরে প্রচুর জলীয় বাষ্পসহ মেঘ জড়ো হয়ে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে।
এ ব্যাপারে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া গবেষক মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, দুটি স্থলনিম্নচাপ একত্র হয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠায় মূলত বৃষ্টি বেড়ে গেছে। এর ফলে ভারত মহাসাগর ও আরব সাগর থেকে আসা মেঘ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর জেট স্টিমের কারণে তা আরও শক্তি অর্জন করছে। যে কারণে বৃষ্টি বেড়ে গেছে। তবে আগামীকাল থেকে বৃষ্টি কমে আসতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, গতকাল সকাল ৬টা থেকে আজ শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ঢাকায় মোট ৬২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর দেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে ময়মনসিংহে।