আমাদের লালচে ডাহুকেরা
দিনভর বাইক্কা বিলে জলচর পাখির ছবি তুলে শ্রীমঙ্গলের পথে রওনা হয়েছি। সঙ্গে আবদুর রউফের অটোরিকশা থাকা সত্ত্বেও অর্ধকিলোমিটার পথ হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এতে আশপাশের পুকুর ও মাছের ঘেরে থাকা পাখিগুলোর খোঁজখবর নেওয়া যাবে। হাঁটতে হাঁটতে বড় একটি পুকুরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎই পানিতে ভাসমান শুকনো কচুরিপানার মধ্যে কিছু একটা নড়তে দেখে সেদিকে ক্যামেরা তাক করলাম। কিন্তু পাখিটি অতি সতর্ক। কচুরিপানার আড়ালে ছদ্মবেশীর মতো হেঁটে বেড়াচ্ছে। মাথা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না, কয়েকটি ক্লিক করলাম। হায় কপাল! ছবিতে এক টুকরা লাল ছাড়া আর কিছুই এল না। এমন সময় পাশ দিয়ে বেসুরো ভট্ ভট্ শব্দে একটি অটোরিকশা চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে টুকটুকে রাঙা পাখিটি কচুরিপানার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল, আর এল না।
বছরখানেক পর পাখিটিকে আবার দেখলাম রাজশাহী শহরসংলগ্ন শিমলা পার্কে ঘাসবনের মাঝে একচিলতে জলার পাশে। তবে এই পাখি ব্যতিক্রম। ঘণ্টাখানেক ওর একদম কাছে থাকলাম অথচ সে পালাল না। এরপর ২০২৩ ও ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ওকে আবারও দেখলাম চট্টগ্রাম শহরের অনন্যা আবাসিক এলাকার হোগলাবনে।
টুকটুকে লাল এই পাখি এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক জলচর পাখি রাঙা খেনি। ওর আরও অনেক সুন্দর সুন্দর গ্রামীণ নাম প্রচলিত আছে। যেমন লাল খেনি, বিলেন হালতি, রাঙা উল্টি, বইদর, পিথা কাগ, লালবুক ঘুরঘুরি, রাঙাবুক বাদা কুক্কুট। পশ্চিমবঙ্গে লাল খয়রি নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পাখি পর্যবেক্ষণের নিত্যসঙ্গী মো. কামাল পারভেজ ওর আরেকটি নাম বলল ‘লাল ডাহুক’। নামটি আমার বেশ মনে ধরেছে। আসলে ডাহুক এই গোত্রেরই সদস্য। চেনার সুবিধার্থেই হয়তো ওরা এটিকে লাল ডাহুক বলে ডাকে।
এ দেশে লাল ডাহুক অর্থাৎ রাঙা খেনির আরও দুটি জাতভাই রয়েছে, যাদের পালকের রঙে লালচে-বাদামির প্রাধান্য। ওরা সবাই ডাহুকের গোত্র অম্বকুক্কুট, জলমুরগি বা রেলিডির সদস্য। মূলত জলচর হলেও স্থলেও বিচরণ করে। ছোট থেকে মাঝারি আকারের পাখিগুলোর চঞ্চু খাটো, ডানা চওড়া, লেজ খাটো, পা মোটামুটি লম্বা ও শক্তিশালী। পাখিগুলো অত্যন্ত লাজুক। তাই সচরাচর ডাক শোনা গেলেও সহজে চোখে পড়ে না। এখানে এই তিন প্রজাতির পাখির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরছি।
এক. রাঙা খেনি (রাডি-ব্রেস্টেড ক্রেক): লেখার শুরুতে যে পাখিটির কথা বলেছি, এটিই সেই রাঙা খেনি বা লালবুক ঘুরঘুরি। বৈজ্ঞানিক নাম Zapornia fusca। প্রধানত খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগের হাওর, বিল, নলবন ও জলাভূমিতে দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের দৈর্ঘ্য ২১ থেকে ২৩ সেন্টিমিটার। ওজন ৬০ থেকে ৮০ গ্রাম। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।
দুই. রাঙা হালতি (স্লেটি-লেগড বা ব্যান্ডেড ক্রেক): লালচে রঙের বিরল আবাসিক পাখিটি বড় হালতি নামেও পরিচিত। ২০১২ সালে পাখিটির প্রজনন প্রতিবেশ নিয়ে গবেষেণা করার সময় ওকে প্রথম দেখি বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের সাতশৈয়া গ্রামে। এ ছাড়া মধুপুর ও খাগড়াছড়িতেও দেখার তথ্য রয়েছে। বৈজ্ঞানিক নাম Rallina eurizonoides। দৈর্ঘ্য ২১ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১০০ থেকে ১৮০ গ্রাম। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাস করে।
তিন. কাগ (ব্রাইন ক্রেক বা বুশ-হেন): অতি বিরল আবাসিক পাখিটির অন্য নাম বাদামি ঘুরঘুরি বা খেনি। বৈজ্ঞানিক নাম Zapornis akool। আঠারো শ বায়ান্ন সালে ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ ভারতের ৩৮ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন রবার্ট সি টিটলার ঢাকায় পাখিটির উপস্থিতির কথা বলেন। দীর্ঘ ১৬৭ বছর পর ২০১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাবুডাইংয়ের সর্পিল এক খাঁড়ি থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের প্রভাষক ডা. নূর-এ-সাউদ পাখিটিকে ক্যামেরাবন্দী করেন। এর দুই সপ্তাহ পর আমি ওর ছবি তুলি। পরে পাখিটিকে শেরপুরেও দেখা যায়। পাখিটির দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ২৮ সেন্টিমিটার। ওজন ১১০ থেকে ১৭০ গ্রাম। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, ভারত, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামে দেখা যায়।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ