দুর্লভ বনশিমুল

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের বনশিমুল
ছবি: লেখক

হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটে অবস্থিত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের সামনে গাড়ি থেকে নামার পর নিজের অজান্তেই চোখ গেল আকাশের দিকে। ফটক প্রাঙ্গণে রাজসিক বৃক্ষের হালকা বুননে পাতার ফাঁক গলে মোহনীয় আকাশ ভেসে আছে।

উদ্যানের প্রবেশপথেও কোনো জটলা নেই। কয়েকটি নির্দেশনা ফলক চোখে পড়ল। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকি; সঙ্গে স্থানীয় গাইড। বনতলে বিচিত্র গাছপালার ঠাসবুনট। চলতি পথে হঠাৎ একটি ধূসরকাণ্ডের উঁচু গাছ দেখে দাঁড়াই। স্বল্প দূরত্বে আরও কয়েকটি আছে। এগুলো ডুমুর। দেশের কোনো বনে এত বড় ডুমুর দেখিনি।

রাজসিক বৃক্ষের মধ্যে সাতছড়ি বনের প্রধান বাসিন্দা চাপালিশ। বনজুড়েই গাছটির রাজত্ব স্বস্তিদায়ক। ঝড়ে উপড়ে পড়া গাছগুলো সরানো হয়নি। নিয়ম নেই। পায়ে চলার এই সরু পথ কোথাও কোথাও বেশ দুর্গম। গোটা বন খুঁটিয়ে দেখতে চাইলে কয়েক দিন সময় প্রয়োজন।

বনের উঁচু গাছের মধ্যে চোখে পড়ল গদজাম, অতিকায় অশ্বত্থ, মান্দার, ডেউয়া, আগর, গর্জন, জারুল, আওয়াল ও মাকড়িশাল। কোথাও কোথাও আছে বাঁশ-বেতের ঝোপ, নীলবনলতা, বিচিত্র ফার্ন, ট্রি-ফার্ন, অর্কিড ও ভূমিজ অর্কিড। বনতলে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে হ্যালিকুনিয়া, ড্রাসিনা আর বনএলাচের ঝাড়।

ট্রেইলের শেষ প্রান্তে এসে বাঁয়ে খাড়া ঢাল বেয়ে খানিকটা ওপরে উঠতেই আবার সমতল। নতুন কিছু পাওয়ার আশায় বনতল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। ওপরেও তাকাই। হঠাৎ ঝকঝকে নীলাকাশের নিচে ফুলভর্তি পাতাহীন একটি গাছে চোখ আটকে গেল। এ গাছের ফুল দেখতে অনেকটা শিমুল ফুলের মতো। সময় হিসাব করে দেখি, ডিসেম্বর মাস। এ সময়ে তো সাধারণ শিমুল ফোটার কথা নয়। এটা আসলে বনশিমুল। সমতলে কোথাও বনশিমুলের একটি গাছও চোখে পড়েনি।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে আবার গাছটির সঙ্গে দেখা হলো রাঙামাটির সাজেক ভ্যালিতে। হোটেলের পেছনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখছিলাম। তখন খানিকটা দূরে নিচের ভ্যালিতে দেখতে পেলাম গাছটি। যথারীতি নিষ্পত্র গাছে বিক্ষিপ্ত কিছু ফুল। চিনতে সমস্যা হয় না। ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখি, গাছটির কাছে পৌঁছানোর মতো কোনো পথ নেই। ক্যামেরা ছিল না সঙ্গে। অগত্যা মুঠোফোনে যতটুকু ধরা যায়, সে চেষ্টাই করি। এদিকটায় পাহাড়ের উদ্ভিদবৈচিত্র্য এখনো আশাব্যঞ্জক বলেই হয়তো দুর্লভ এই বৃক্ষের দেখা পেলাম।

রাঙামাটির সাজেক ভ্যালিতে দেখা বনশিমুল
ছবি: লেখক

বনশিমুলের বৈজ্ঞানিক নাম Bombax insigne, এটি পাহাড়ি শিমুল নামেও পরিচিত। চাকমাদের দেওয়া নাম ‘শিমেন’ গাছ। এগুলো বৃহৎ বৃক্ষ, প্রায় ৩০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। বাকল সাদাটে রঙের, কখনো শক্ত গা কাঁটায় ভরা থাকে, আবার কোনো কোনো গাছে কাঁটা থাকে না। পুংকেশর অনেক, ৬ থেকে ৮ সেন্টিমিটার লম্বা, পরাগধানী এক কোষী। গর্ভদণ্ড লম্বা, বেলনাকার, গর্ভমূল গাঢ় লাল। ফল বিদারী, আপনাআপনি ফেটে যায়। বীজ ক্ষুদ্র, গোলাকার, অনেক। ফুল ও ফলের মৌসুম ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল।

বনশিমুল ভারত, মিয়ানমার, চীন, লাওস ও থাইল্যান্ডে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট জেলায় দেখা যায়।

এ গাছের তুলা সুতা, বালিশ ও তোশক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। সাধারণ শিমুল, যার বৈজ্ঞানিক নাম Bombax ceiba, এর কাঠের চেয়ে বনশিমুলের কাঠ বেশি টেকসই। এ গাছের কাঠ খেলনাসামগ্রী ও বাড়ির আসবাব তৈরিতে কাজে লাগে।

বর্তমানে আবাসস্থল ধ্বংস, অবৈধভাবে গাছ কাটা ও বন উজাড়ের কারণে এই উদ্ভিদ প্রজাতি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক