হাতির ভালোবাসার সংসার

শুঁড় দিয়ে পানি ছিটিয়ে বাচ্চার শরীর পরিষ্কার করে দিচ্ছে মা হাতি। শেরপুরের নালিতাবাড়ী এলাকায়ছবি: মোস্তফা ফিরোজ

হেমন্তের দুপুরবেলা। রোদের খুব বেশি তাপ নেই। বনের ভেতর একটি হাতির পাল। এই পালের কাছে মানুষ তো দূরের কথা, কোনো প্রাণীরই যাওয়ার সাহস নেই। এ রকম একটি হাতির পালের ছবি দেখে মনটা ভরে গেল। একপাল হাতি তাদের বাচ্চাদের আগলে রেখে ঘুম পাড়াচ্ছে। ছবিটি তুলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অরিত্র সাত্তার, শেরপুরের নালিতাবাড়ী এলাকা থেকে। পুরো দলে ১২টি হাতির মধ্যে তিনটি বাচ্চা ছিল। তিনটি বাচ্চাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আর তাদের ঘিরে রেখে পরিবারটি পাহারা দিচ্ছে। মা-বাবা হাতির যেন কোনো বিশ্রাম নেওয়ার সুয়োগ নেই! দেখলে মনে হবে হাতির পালটি এক সুখী পরিবারের প্রতিচ্ছবি।

হাতি দেখার নেশায় গত দুই দশকে দেশের প্রায় সব বনেই গেয়েছি। বনের ভেতর কখনো কখনো হাতির ছবি তুলতে গিয়ে হাতির তাড়াও খেয়েছি। তবে শেরপুরের নালিতাবাড়ী এলাকার হাতি পরিবারের এই গল্পের মতো ছবি খুব কমই দেখেছি।

পুরো শেরপুর ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলজুড়ে হাতির বড় একটি দল আছে। সংখ্যায় তা এক শর কাছাকাছি। মূলত তিনটি বড় দলে ভাগ হয়ে তারা বেশ কয়েকটি এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট দলেও বিভক্ত হয়ে যায়। প্রতিটি দলেই এখন মা-বাবার সঙ্গে বাচ্চাদের দেখা যায়। সম্প্রতি অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজও একটি অসাধারণ হাতির ভিডিও করেছেন এই অঞ্চল থেকে। পাহাড়ে ধাপ চাষের ফলে একটি উঁচু-নিচু জমির গর্তে হাতির একটি বাচ্চা আটকা পড়েছিল। হাতিটির মা শুঁড় দিয়ে পুরো গর্তটি ঠিক করলে বাচ্চাটি নিরাপদ স্থানে উঠে যায়। তারপর সেই মা হাতি পানি ছিটিয়ে বাচ্চার শরীর পরিষ্কার করে। কী অসাধারণ দৃশ্য! হাতির এই সামাজিক আচরণ থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে।

শেরপুরের নালিতাবাড়ী এলাকায় হেমন্তে ধান কাটার মৌসুমে হাতির দল আসে ফসলের খেতে খাবারের খোঁজে। মানুষের সঙ্গে এই নিয়েই যত গন্ডগোল হয়। হাতি-মানুষের দ্বন্দ্বে হাতির মৃত্যুর খবর শুনলে খুব খারাপ লাগে। কখনো কখনো মানুষের মৃত্যু অথবা আক্রমণের খবর শুনি। ভারতের সীমানা ঘেঁষে সামান্য বনভূমিতে খাবারের অভাবেই এসব সমস্যা হচ্ছে বলে গবেষকদের ধারণা।

শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে হাতির এই পালের ভেতর ছোট্ট একটি বাচ্চা হাতি ঘুমাচ্ছে। এ সময় পাহারা দেয় হাতি পরিবার। গত ১৬ নভেম্বর
ছবি: অরিত্র সাত্তার

আমাদের দেশে আবাসিক বুনো হাতির সংখ্যা প্রায় ২৬৮। বৃহত্তর শেরপুর অঞ্চলে যে হাতি দেখা যায়, সেগুলো অনাবাসিক। এখানে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানার কাছাকাছি হাতিগুলো বিচরণ করে। ভারতের সঙ্গে যখন সীমানাপ্রাচীর ছিল না, তখন হাতির চলাচলে কোনো বাধাও ছিল না। এখন মুক্তভাবে হাতিরা দুই দেশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ঘুরে বেড়াতে পারে না। অনেক প্রতিকূলতায় হাতিগুলোর স্বভাবেরও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। হাতির মতো একটি বিশালদেহী প্রাণী এই শেরপুর এলাকায় অনেক সময় মানুষ দেখলেও ভয় পায়। ঠিক এ কারণেই হাতির দল তাদের বাচ্চাদের ঘুমানোর সময় পালা করে সতর্ক পাহারা দেয়।

এ দেশের স্থলভাগের সবচেয়ে বড় প্রাণীটির নাম হলো হাতি। পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট আর শেরপুর অঞ্চলের বনগুলোতেই মূলত হাতিরা টিকে আছে। একটি হাতির দিনে প্রায় ১৫০ কেজি খাবার লাগে। এর সঙ্গে লাগে প্রায় ১৫০ লিটার পানি। তার বিচরণের জন্য জায়গা লাগে অনেক। একটি বুনো মা হাতি তার জীবদ্দশায় সাধারণত চার থেকে ছয়টি বাচ্চা দেয়। আর মা হাতি তিন থেকে পাঁচ বছর পরপর বাচ্চা দেয়। প্রতিবছর আমাদের হাতির দল থেকে কতগুলো বাচ্চা পাওয়া যায়, এর সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। তবে গত দুই যুগে এ দেশে হাতির সংখ্যা না বেড়ে বরং কমেছে।

আমাদের যেসব বনে হাতি আছে, সেসব বন হাতির বসবাস উপযোগী করে সাজালেই অনেক সমস্যার সমাধান হবে। এ ক্ষেত্রে হাতির চেয়েও মানুষেরই বেশি উপকার হবে। শেরপুরের ভালোবাসার হাতির সংসার টিকে থাক অনন্তকাল—এই আশা সবার।