সুন্দরবনের বৈচিত্র্যময় ফল ছইলা
গহিন সুন্দরবনের শিবসা নদী ধরে আমাদের ছোট নৌকাটি এগিয়ে চলছে। উজান হলেও স্রোত কম থাকায় বইঠা বেয়ে এগোতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না। এরই মধ্যে সূর্য কোমলতা ঝেড়ে উষ্ণ হতে শুরু করেছে। হালকা কুয়াশা গায়ে মেখে শিবসা নদীর পাড়ে একদল চিত্রা হরিণ বিচরণ করছে। নদীজুড়ে শুরু হয়েছে আলোর খেলা। লাল সূর্যের প্রতিফলন পড়ছে নদীতে। সোনালি আভা ছড়িয়ে গেছে চারপাশে।
এর মধ্যে চোখ আটকে যায় নদীপাড়ে বনের গাছে ধরে থাকা অদ্ভুত এক ফল দেখে। ফলগুলো দেখতে অনেকটা গোলাকার কেওড়া বা ডুমুরের মতো। তবে আকারে কেওড়ার চেয়ে বেশ বড়।
গাঢ় সবুজ ডিম্বাকার পাতার ফাঁকে থরে থরে ঝুলে থাকা ওই ফল দেখিয়ে নৌকার বইঠা বাইতে বাইতে জেলে লিয়াকত আলী বললেন, ‘ওই ফলটারে কয় “ছইলা ফল”। খাইতে কেওড়ার মতন টক। আমাদের কাছে পোলাও মাংস বিরিয়ানি এসব খাবার যেরকম ভালো লাগে, সুন্দরবনের হরিণ আর বান্দরের কাছেও এই ফল (ছইলা) তেমনডাই লাগে। বান্দরের (বানর) দল গাছে উঠে ছইলাগাছের পাতা আর ফল নিচে ফেলে আর হরিণ সেগুলো খায়। সুন্দরবনে হরিণের সাথে বান্দরের বন্ধুত্ব আছে।’
নৌকা বেয়ে ছইলাগাছের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছাতেই দেখা গেল ছইলাগাছে ফলের পাশাপাশি নয়নাভিরাম ফুলও ফুটে আছে। ছইলা ফুলের কলি বেশ শক্ত ও মোটা। আর ফোটা ফুলে পাপড়ির বদলে ধরে আছে ব্রাশের মতো অগণিত লোমশ কলি। সেগুলো সাদা আর গোলাপির আবহে ফুটে থাকে কেশগুচ্ছের মতো। আর ফুলের মাঝখান দিয়ে বেশ বড় কেশরদণ্ড ফুলের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। ফলের সঙ্গেও রয়েছে ওই লম্বাটে দণ্ড।
১৯০৩ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞানী ডেভিড প্রেইন সুন্দরবন ও তার আশপাশের এলাকার ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালার তালিকা তৈরি করেন। তার মধ্যেও রয়েছে ছইলাগাছের নাম। সুন্দরবনের বাতাস, জল ও মাটি সবই লবণাক্ত। যে কারণে এখানকার গাছপালাও বিচিত্র। ছইলাগাছ লবণ সহ্য করতে পারে। ছইলাগাছ নরম কাদার ওপর জন্মায়। প্রবল হাওয়া এবং প্রচণ্ড স্রোতে অসংখ্য শিকড়ের সাহায্যে এই নরম মাটির ওপর সহজেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। জোয়ারের পানিতে গাছের গোড়া সব সময় ধুয়ে গেলেও ছইলাগাছের কোনো ক্ষতি হয় না। বাতাস থেকে অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প নেওয়ার জন্য ছইলাগাছের গোড়ায় শূলের মতো সুচালো শ্বাসমূল থাকে।
ছইলা মাঝারি গড়নের চিরসবুজ গাছ। বাকল ধূসর বা বাদামি। উচ্চতায় সাধারণত ১০ থেকে ১৫ মিটার হয়ে থাকে। ছইলার বৈজ্ঞানিক নাম Sonneratia caseoloris। পরিবার Sonneratiaceae। ছইলাগাছে সাধারণত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ফুল আসা শুরু করে। সেই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ছইলা ফল পাওয়া যায়। সবুজ রঙের ফলের ওপরের মাংসল অংশ টক স্বাদের। পাকলে কিছুটা হলদে রঙের হয়। ভেতরে বেশ বড় বীজ। ১০ থেকে ১২টি ফলে প্রায় এক কেজি ওজন হয়। ছইলা ফল আঞ্চলিক ভাষায় ‘ওড়া’ নামেও পরিচিতি।
ছইলা ফল সুন্দরবনের হরিণ ও বানরের কাছে বেশ লোভনীয় একটি খাবার। বহু আগে থেকে সুন্দরবন–সংলগ্ন এলাকার মানুষও এই ফল পাতে তুলেছে। কাঁচা খাওয়ার পাশাপাশি এ ফলের সঙ্গে চিংড়ি ও মসুরের ডাল মিশিয়ে বিশেষ একটি পদ রান্না করা হয়। ছইলা ফল থেকে বানানো যায় আচার ও চাটনি। ভর্তা করেও খায় অনেকে। ছৈলা ফুল সারা রাত ভিজিয়ে অনেকে সুস্বাদু মধুও সংগ্রহ করে। ছইলা ফল সুন্দরবনের পাঙাশ মাছেরও প্রিয় খাদ্য। জোয়ারে জলাবদ্ধ ছইলাগাছের নিচে পাঙাশ মাছ আসে ফল খেতে। সুন্দরবনে রাতে ছইলাগাছে সবচেয়ে বেশি জোনাকি পোকা আশ্রয় নেয়।