একঝাঁক কমলাবুক হরিয়াল

কমলাবুক হরিয়াল, সুন্দরবন থেকেছবি: লেখক

‘একভিড় হরিয়াল পাখি

উড়ে গেলে মনে হয়, দুই পায়ে হেঁটে

কত দূর যেতে পারে মানুষ একাকী।’

—জীবনানন্দ দাশ

শেষ বিকেল। সুন্দরবনের শেলা নদীর জল যেন আরও শান্ত হয়ে গেছে। আকাশের নীল রং ম্লান হয়ে গেছে। চারদিকে সন্ধ্যার আয়োজন। বুনো ঝিঁঝি পোকারা ডাকা শুরু করেছে। আমাদের গন্তব্য সুন্দরবনের কটকা। এখনো অনেক দূরে কটকা। নদীর পথে রাতে কোথাও যাত্রাবিরতি দিতে হবে। গোলপাতার নৌকা বেয়ে গন্তব্যে ছুটছে মাঝি। বনের মধ্যে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই পাখিরা নিরাপদ জায়গায় উড়ে যায়। রাতে অনেক পাখি একসঙ্গে রাত কাটায়। খুব সকালেই তারা আবার খাবারের জন্য বনের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।

তখন সুন্দরবনের মাছরাঙার ডাক থেমে গেছে। চন্দনা শালিকের ঝাঁক ডানা কাঁপিয়ে উড়ে যাচ্ছে। জাহাজের ছাদে বসে কেবল পাখিদের ওড়াউড়ি ও বনে নেমে আসা সন্ধ্যার নির্জনতা উপভোগ করছি। ঠিক এমন সময় কোথা থেকে একঝাঁক কমলাবুক হরিয়াল উড়ে এসে বসল একটি গাছে। গুনে দেখলাম সংখ্যায় তারা ১৭। একঝাঁকে এতগুলো হরিয়াল দেখা সহজ নয়। রাত কাটানোর জন্য ওরা একসঙ্গে পথ চলছে। গাছটিতে কোনো পাতা নেই, যে কারণে উদ্ভিদটি শনাক্ত করা গেল না। কিছুক্ষণ পরই হরিয়াল পাখিগুলো বনের গভীরে হারিয়ে গেল। মনে হয়েছে, কোনো পত্রপল্লবের ঘন বুননে আচ্ছাদিত কোনো বুনো বৃক্ষের শাখায় বসেছে। আমি কেবল মুগ্ধ হয়ে ওদের পালকের রং দেখলাম এবং উড়ে যাওয়ার সময় বাতাসে ডানার শব্দ শুনলাম। কবি জীবনানন্দ দাশের কয়েকটি লাইন মনে পড়ে গেল—

‘কখনো দেখিনি নিভে গেছে/ হরিয়াল প্রান্তরের পারে চলে গেছে/ ডানার ঝিলিকে তার সবচেয়ে শেষ রোদ্দুর/ জ্বালিয়ে সে সূর্যকে নিভিয়ে এবার নিভে গেল।’

কমলাবুক হরিয়াল মূলত বনের পাখি। যে কারণে বনের গভীরে থাকতেই পছন্দ করে। রাঙামাটির কাপ্তাই বনে গিয়ে কয়েকবার কমলাবুক হরিয়াল পর্যবেক্ষণ করেছি। বুনো গাছের পাকা–ফল খেয়ে তারা বেশির ভাগ সময় কাটায়। পিপাসা লাগলে বনের প্রান্তরের কোনো জলাশয়ে জল পান করতে নামে। সুন্দরবনে দেখেছি, বনের পুকুরে তারা জল পান করতে আসে।

কমলাবুক হরিয়াল বৃক্ষচারী পাখি। এরা পাহাড়ি বন ও প্যারাবনে বিচরণ করে। সচরাচর ছোট ঝাঁকে থাকে। মাঝেমধ্যে একাকীও দেখা যায়। ফলভরা গাছে বিচরণ করে। বিশেষ করে বনের বট ও পাকুড়। তা ছাড়া বুনো জাম, হেঁতাল, খেজুর, ডুমুরসহ অন্যান্য বৃক্ষে বিচরণ করে। প্রধানত উঁচু বৃক্ষ তাদের পছন্দ। স্বভাবে লাজুক প্রকৃতির, জনমানুষের উপস্থিতি টের পেলে তারা চারদিকে গলা ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ করে। বিপদ বুঝলে দ্রুত কেটে পড়ে বনের গভীরে লুকিয়ে পড়ে।

কমলাবুক হরিয়ালের পা লাল। গায়ের পালকের রং হলদে-সবুজের মিশ্রণ। লেজে দারুচিনি রঙের পালক আছে। বুকের নিচের অংশে কমলা রঙের আভা থাকে। প্রজনন মৌসুমে এরা শিস দিয়ে ডাকে। গাছের শাখায় মাচার মতো বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। পালা করে উভয় পাখি ডিমে তা দেয়। ডিমের রং সাদা এবং সংখ্যায় দুটি। ১২-১৪ দিনে ডিম ফুটে ছানা আসে। উভয় পাখি ছানাদের লালনপালন করে। ভারতের হিমালয়, তিরাই এলাকাসহ উপমহাদেশের সব দেশেই কমলাবুক হরিয়াল দেখা যায়।

  • সৌরভ মাহমুদ, নিসর্গী ও পরিবেশবিদ