মধুপুরের মুখপোড়া হনুমান
জনবহুল ঢাকা শহরের কোলাহল ছেড়ে আমাদের গবেষণা দলের গাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুরের পথে এগিয়ে চলে। মনে হয় যেন প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করছি। মধুপুরের হনুমান নিয়ে আমার গবেষণা দলের সদস্যরা ছিলেন মো. মাহাবুব আলম, আশিকুর রহমান, অর্ণব সাহা ও মো. আফজাল হোসেন।
আমাদের তখন একটিই চিন্তা, মধুপুরের মুখপোড়া হনুমানকে কীভাবে রক্ষা করা যায়। গবেষণার জন্য হনুমানের সঙ্গে আমাদের কাটাতে হয়েছে অনেক সময়। অর্থায়নের সংকট থাকা সত্ত্বেও ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে নিবিড়ভাবে হনুমান গবেষণার কাজ করে যাচ্ছি আমরা।
মধুপুর জাতীয় উদ্যানের সবুজে ঘেরা গভীর বনভূমিতে বাস করে এই মুখপোড়া হনুমান (Trachypithecus pileatus)। বাংলাদেশে দেখা যায় এমন তিন প্রজাতির হনুমানের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে এদেরই আধিক্য। এরা দেশের উত্তরে মধুপুরের শালবন, উত্তর-পূর্বে সিলেটের বনাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বে চট্টগ্রামের বনভূমিতে বসবাস করে। ১৯৯৪ সালে বন্য প্রাণী বিষয়ে এমএসসিতে পড়তে এসে এদের প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা আজও মনের কোণে গেঁথে আছে। কালচে চামড়ার ওপর ধূসর বাদামি লোমের আবরণ, বুক ও পেটে কখনো লালচে, কখনো সোনালি আভা দেখা যায়। মুখ ও কানে লোমহীন কুচকুচে কালো ত্বক, হাত-পা কালো ও শক্তিশালী। মাথার ওপরে কালো লোমের শিরস্ত্রাণসদৃশ একটি আবরণ যেন বিশেষ কোনো টুপি পরানো।
মুখপোড়া হনুমান লম্বা লেজের ওপর ভর করে গাছের শাখায় শাখায় লাফিয়ে বেড়ায়। এদের চলাফেরায় রয়েছে একধরনের সাবলীলতা, যা বলে দেয় এই গভীর বনই তাদের প্রকৃত আশ্রয়। বেশির ভাগ সময় গাছের ডালে শান্তভাবে বসে বিশ্রাম নেয়, আবার কখনো হঠাৎ গাছের ডালপালা ধরে লাফিয়ে চলে। এরা সাধারণত ৭ থেকে ১৫ সদস্যের ছোট দলে চলে, যেখানে একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ থাকে, যাকে ‘আলফা’ পুরুষ বলা হয়। সে হচ্ছে দলনেতা। আর বাকিরা প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী হনুমান, অপ্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী-পুরুষ ও শিশু। অনেক সময় দেখা যায়, মা হনুমান তার বাচ্চাকে বুকের সঙ্গে নিয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে চলাফেরা করে। এরা সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে—অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাসে প্রজনন করে থাকে। তিন থেকে চার বছরের মধ্যে এরা প্রজননে সক্ষম হয়ে ওঠে। এদের গর্ভকাল হলো ছয় থেকে সাত মাস। এরা বছরে সচরাচর একটি বাচ্চা প্রসব করে থাকে।
মুখপোড়া হনুমান মূলত পত্রভোজী। গাছের কচি পাতা, কুঁড়ি, ফুল—এসবই এদের প্রধান খাবার। তবে বনচালতা, কলা আর বহেড়ার মতো ফলও এ হনুমানের কাছে বেশ প্রিয়। এক গাছ থেকে আরেক গাছে ঘুরে বেড়ানোর সময় এরা বিভিন্ন গাছের পরাগায়নেও ভূমিকা রাখে। তা ছাড়া বিভিন্ন ফলের বীজ বিচ্ছুরণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বনায়নে এদের ভূমিকা অপরিসীম। এদের উপস্থিতি বনের ভারসাম্য রক্ষা এবং পরিবেশের স্বাভাবিক গতিধারা বজায় রাখতে সহায়তা করে। এদের দিনের শুরুতে, বিকেলে ও সন্ধ্যায় বেশি সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। অন্যদিকে দুপুরের রোদ এড়াতে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। বিভিন্ন ঋতুতে বনের পরিবর্তনও এদের চলাফেরায় বড় রকমের প্রভাব ফেলে।
কয়েক দশক ধরে ক্রমেই বনভূমি সংকুচিত হচ্ছে এবং মুখপোড়া হনুমানের প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎস কমে আসছে। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে তাদের বনের বাইরের খাদ্যের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। খাদ্যের অভাবে প্রায়ই এদের নিরাপদ আশ্রয় ত্যাগ করে আশপাশের গ্রাম ও কৃষিজমিতে যেতে হয়। এতে কৃষকের ফসল নষ্ট হয়। তা ছাড়া বনের ভেতর দিয়ে ব্যস্ততম সড়কের এক পাশ থেকে আরেক পাশে পার হতে গিয়ে অনেক সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যায় অনেক হনুমান।
গত তিন বছর মধুপুরের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে আমরা বুঝতে পেরেছি, বনভূমি হ্রাসই মানুষ ও হনুমানের সহাবস্থানের প্রধান অন্তরায়। হনুমান নিয়ে আমাদের গবেষণার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা, যাতে মানুষ ও মুখপোড়া হনুমান উভয়েই সহাবস্থানের সুযোগ পায়। প্রাকৃতিক ভারসাম্যও বজায় থাকে।
সম্ভাব্য সমাধানগুলোর মধ্যে রয়েছে—বনভূমি সম্প্রসারণ, স্থানীয় কৃষকদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা এবং মানুষের মধ্যে হনুমান ও মানুষের সহাবস্থানসংক্রান্ত শিক্ষামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি। মধুপুরের বনাঞ্চল আরও ঘন ও সবুজায়িত হলে হনুমানের খাদ্যসংকট কিছুটা কমতে পারে। ফলে হয়তো একদিন মুখপোড়া হনুমান এ বনের গহিনে নিশ্চিন্তে বিচরণ করবে আর মধুপুরের গ্রামবাসী তাঁদের ফসল নিয়ে চিন্তামুক্ত জীবন যাপন করতে পারবেন।
মোহাম্মদ ফিরোজ জামান, অধ্যাপক ও প্রাণিবিজ্ঞানী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়