এ বছর কয়েকটি ভূমিকম্পেরই উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ। এ অঞ্চলে কেন এত ঘন ঘন ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে?
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণায় আমরা ১২ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছি। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, সাবডাকশন জোন সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওর হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে চলে গেছে। এই রেখা ভারতের প্লেট, যেটা পশ্চিমে অবস্থিত, সেটি পুবের যে পাহাড়ি অঞ্চল, তার নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। এই জোনে বিপুল শক্তি প্রায় হাজার বছর ধরে সঞ্চিত হয়ে আছে। এতে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার পর্যন্ত ভূমিকম্প হতে পারে।
এই জোনের মধ্যে আবার দুটি ভাগ আছে। একটা হলো লক জোন, যেটি আমাদেরই অংশ। সেখানে ইন্ডিয়া (ভারত)ও বার্মা (মিয়ানমার) প্লেট আটকে আছে, একটির সঙ্গে আরেকটি। আর আরেকটি জোন হলো আমাদের পূর্ব দিকের অঞ্চল যেটি মিয়ানমার ও মিজোরাম অঞ্চলে। এ অঞ্চলে প্রায়ই ভূমিকম্প হওয়ার খবর পত্রপত্রিকায় আসে। তবে আমাদের অঞ্চলটিতে সব সময় এমন ভূমিকম্প হয় না। কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি, এখানে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প হচ্ছে। এটা বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পূর্বলক্ষণ।
সাবডাকশন জোনে যে ভূমিকম্প হবেই, তার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, যে পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে, তা একদিন না একদিন বের হবেই। সেটি আজ হোক, কাল হোক বা ৭০ বছর পরে হোক। তা যদি হয় তবে তা হবে মারাত্মক ধরনের ভূমিকম্প। আর ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের মতো জনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোয়।
হঠাৎ রামগঞ্জে কেন ভূমিকম্প?
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: আজকের ভূমিকম্পটি সাবডাকশন জোনে হয়েছে। এ অঞ্চলে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে, তাতে এ বেল্টের যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় ভূমিকম্প হতে পারে। অর্থাৎ সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এ বেল্টে যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় ভূমিকম্প হতে পারে। আজকে হলো রামগঞ্জে, পাঁচ মাস আগে হলো নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। এগুলো তো সাবডাকশন জোনের মধ্যে। এখন সাবডাকশন জোনের যেকোনো জায়গায় ভূমিকম্প হওয়ার মানে হচ্ছে বড় ভূমিকম্প হওয়ার পূর্বলক্ষণ।
৫.৫ বা ৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্প কতটা ঝুঁকির?
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: ২০০৩ সালে রাঙামাটিতে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। সেখান থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রামে বিদ্যুতের একটি ট্রান্সমিটার ধ্বংস হয়ে যায়। সেখানে দুই দিন বিদ্যুৎ ছিল না।
সেখানে রাস্তাঘাট এবং অনেক জায়গায় ভূমিধসও হয়। আজকে যে ভূমিকম্প হলো, সেটার উৎপত্তিস্থল গ্রামাঞ্চলে হওয়ায় হয়তো তেমন একটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এটাই যদি আবার কুমিল্লা শহরে বা চট্টগ্রাম শহরে অনুভূত হতো, তখন অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত।
সাগরে নিম্নচাপ চলছে। এ সময়ে ভূমিকম্প হলো। এ দুটির মধ্যে কোনো সংযোগ আছে কি না কিংবা ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায় কি না?
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: না, এগুলোর মধ্যে সংযোগ নেই। সংযোগ এতটুকুই হতে পারত, যদি একই সময়ে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে আবার ভূমিকম্প হয়েছে, তখন হয়তো উদ্ধারকাজের ওপর প্রভাব পড়তে পারত, উদ্ধারকাজ ব্যাহত হতো। এ ছাড়া অন্য কোনো প্রভাব নেই।
ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, আজকের ভূমিকম্পটি ছিল ভূগর্ভের ১০ কিলোমিটার গভীরে? গভীরতা অনুযায়ী ভূমিকম্পের ঝুঁকি কতটা কম বেশি হতে পারে?
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: ভূমিকম্পের উৎপত্তি ভূগর্ভের যত কম গভীরে হবে, তা তত বিপজ্জনক। ৫-১০ কিলোমিটার বা ২০ কিলোমিটার গভীরতা বিপজ্জনক।
ঢাকার জন্য এ রকম ভূমিকম্প কতটা ঝুঁকির?
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: আমাদের যে সাবডাকশন জোন সেখানে ৮ দশমিক ২ মাত্রার অধিক মাত্রার ভূমিকম্প যেকোনো সময় হতে পারে। ছোটখাটো ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্বলক্ষণ। এখন এ ভূমিকম্প ঢাকার জন্য কতটা ঝুঁকির, সেটা সেভাবে বলা মুশকিল। বড় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হলো সিলেট থেকে কক্সবাজার জোনের যেকোনো জায়গায়। এখন এ সাবডাকশন জোনের যেকোনো জায়গায় যদি ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তবে উৎপত্তিস্থলের কাছের এলাকার চেয়েও ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে। কারণ, ঢাকাতে জনবসতি বেশি, নগরায়ণ খারাপ, সরকারেরও প্রস্তুতি কম। সে কারণে ঢাকার ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বেশি।
ঋতুভেদে ভূমিকম্প হওয়ার প্রবণতা কম বেশি হতে পারে কি না?
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: আমাদের এখানে ঐতিহাসিক যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছে, গত ৪০০ বছরের যে ডেটা আমাদের কাছে আছে, সেখানে আমরা দেখছি বড় ভূমিকম্পগুলো বর্ষা মৌসুমে বা বর্ষা–পরবর্তী সময়ে হয়ে থাকে।
ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: আমাদের এখনো সময় রয়েছে পরিকল্পনা নেওয়ার। সরকারকে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। তবে সরকার যে পরিকল্পনা নিচ্ছে, সেটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। সেটাতেও কিছুটা ভুল আছে। এ ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের পরবর্তী উদ্ধারকাজের জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতি যেন না হয়, তার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
ভূমিকম্প হলে কোথায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে, কোথায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উদ্ধারকারী দল ও চিকিৎসক দল দ্রুত পাঠাতে হবে, কোন জায়গাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, সেগুলো নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা দেখছি না। আমি মনে করি, আমরা যেহেতু অনেকেই স্মার্টফোন ব্যবহার করি, সে ক্ষেত্রে স্মার্টফোন ব্যবহার করে জনগণকে সচেতন করা যেতে পারে।
কেননা, আমরা যে অবকাঠামোর মধ্যে বসবাস করছি, অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত যে নগরায়ণ করা হয়েছে, এর মধ্যে অনেক ভবন আছে দুর্বল প্রকৃতির, যেগুলো ভূমিকম্পে ভেঙে পড়তে পারে। আবার কিছু ভবন আছে নকশাজনিত ত্রুটির কারণে ভূমিকম্প হলে ভেঙে বা ধসে পড়তে পারে। এখন যে অংশগুলো নিরাপদ, সেটা যদি আমরা জনগণকে আগে বলে দিতে পারি যে এ অংশ নিরাপদ, তাহলে তারা ভূমিকম্পের সময়ে সেখানে সরে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা স্মার্টফোনের সহায়তা নিতে পারি।
টেক্সট পাঠিয়ে আমরা জনগণকে সচেতন করতে পারি যে ভূমিকম্পের আগে কী করা উচিত, ভূমিকম্পের সময় তারা কীভাবে নিজেদের নিরাপদ রাখবে এবং ভূমিকম্পের পরে তাদের করণীয় কী হবে।