এবার এপ্রিলের আবহাওয়ায় যত ব্যতিক্রম
এ বছর এপ্রিলে মাত্র একটি বজ্রঝড় হয়েছে। ১৯৮১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এত কম বজ্রঝড় আগে হয়নি।
এই গরমের মধ্যে কৃষিজমিতে কাজ করা রাশেদ আলীর (৬৫) কাছে ‘আজাবের’ মতো। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার জালশুকা গ্রামের বাসিন্দা রাশেদ আলী। গতকাল শুক্রবার তিনিসহ চার শ্রমিক মিলে ভুট্টাখেতে কাজ করছিলেন। রাশেদ আলী বলছিলেন, ‘এমন গরম আগে দেহিনি। এ গরমে আমাদের ওপরে আজাব; কিন্তু কাজ তো করতি হয়। না করলি তো পেট চলবে না।’
গতকালই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় রাশেদ আলীর বাসস্থান চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি এ বছর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। গতকাল রাজধানীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিনের চেয়ে গতকাল প্রায় ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমেছে।
এপ্রিল মাসের প্রথম দিন থেকে গতকাল টানা ২৬ দিন দেশে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র বলছে, গত ৭৬ বছরে কোনো এপ্রিল মাসে এমনটি হয়নি। এ বছর এপ্রিল মাসে মাত্র একটি বজ্রঝড় বা কালবৈশাখী হয়েছে। তা–ও হয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে। ১৯৮১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এত কম বজ্রঝড় আগে হয়নি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বজ্রঝড়ের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
তীব্র তাপ্রবাহ, জলবায়ু পরিবর্তন, বজ্রমেঘ সৃষ্টি না হওয়া—এসব কারণেই এবার বজ্রঝড়ের সংখ্যা কম বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, বজ্রঝড় কমে যাওয়ার এ অবস্থা অস্বাভাবিক।
দেশে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বজ্রঝড় হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকারের মতে, সব কালবৈশাখীই বজ্রঝড়। কিন্তু সব বজ্রঝড় কালবৈশাখী নয়। কারণ কী?
এই আবহাওয়াবিদের সহজ ব্যাখ্যা—মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত যেসব বজ্রঝড় হয়, সেগুলো আসলে কালবৈশাখী। উত্তর–পশ্চিম দিক থেকে আসা বায়ুর কারণে যে ঝড়বৃষ্টি হয়, তাকে ইংরেজিতে নরওয়েস্টার বলে। সেটিই কালবৈশাখী।
এপ্রিলে ঝড় কমছে
এপ্রিল মাসে যেটা চিরাচরিতভাবে হয়ে আসে, তা হলো এ মাসে প্রচণ্ড গরম পড়ে। আবার একসময় বজ্রঝড় হয়ে সেই গরম প্রশমিত হয়। তারপর আবহাওয়া একসময় গরম হয়। এভাবে তাপ ও ঝড়বৃষ্টির মধ্য দিয়ে চলে এ মাস; কিন্তু দিন দিন এপ্রিল মাসে তাপপ্রবাহ বাড়ছে, কমছে বজ্রঝড়ের সংখ্যা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি ১৯৮১ থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাসের উপাত্ত তুলে ধরেছেন তাঁর গবেষণায়। এই ৪৩ বছরে এপ্রিল মাসে ৩৬৫টি বড় বজ্রঝড় হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝড় হয়েছিল ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে, ১৪টি। আর ১৯৯৯ এবং ২০০৯ সালে সবচেয়ে কম, ৪টি করে ঝড় হয় এ মাসে। গত বছর (২০২৩) এ মাসে বজ্রঝড় হয়েছিল সাতটি। ২০২২ এবং ২০২১ সালে হয় যথাক্রমে নয়টি ও আটটি; আর এ বছর হয় মাত্র একটি।
দক্ষিণের বজ্রঝড় অস্বাভাবিক
চলতি মাসের ৭ তারিখে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বাগেরহাটের বিভিন্ন স্থানে বজ্রঝড় বা কালবৈশাখী বয়ে যায়। ঝড়ের সময় বজ্রপাতে বাগেরহাটে একজনের মৃত্যুও হয়। তবে দক্ষিণ জনপদের মানুষের কাছে এ সময় ঝড় বেশ অস্বাভাবিক।
পিরোজপুর শহরের বাসিন্দা জগৎপ্রিয় দাশ (৬৭) কৃষি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। শহরের নাসিরনগরের এ বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতায় এ সময়ে এত বড় ঝড় দেখিনি। এ সময়ে দক্ষিণ এলাকায় সাধারণত এমন ঝড় হয় না।’
দক্ষিণের সাধারণ মানুষের মতো এ সময়ের বজ্রঝড় ভাবিত করেছে আবহাওয়াবিদদেরও।
আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলছিলেন, এ সময়ের ঝড় সাধারণত দেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চল থেকে মধ্যাঞ্চলে শুরু হয়। এবার এর ব্যতিক্রম ঘটল।
এপ্রিলে ঝড় কমছে কেন
এপ্রিল মাসে ঝড় কমে যাওয়ায় অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহকেই কারণ মনে করেন বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম। তিনি জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) সঙ্গে যুক্ত।
অধ্যাপক সাইফুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাপমাত্রা বৈশ্বিকভাবে ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এ বছরের এপ্রিল মাস ভারতে ১২২ বছরের মধ্যে ছিল সবচেয়ে বেশি উষ্ণ। আমাদের যে বায়ুপ্রবাহ, তার সঙ্গে সীমান্তসংলগ্ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওডিশার সম্পর্ক আছে। এ সময় এসব অঞ্চলে সাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্প বজ্রমেঘের সৃষ্টি করে। কিন্তু এবার ভারতের ওই সব অঞ্চলেও প্রচণ্ড গরম পড়েছে। আর্দ্রতাপূর্ণ জলীয় বাষ্প জড়ো হয়ে বজ্রমেঘ সৃষ্টি করেনি। তাতেই এ বিড়ম্বনা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এ অবস্থা দেখছি আমরা।’
বাংলাদেশের ঝড় নিয়ে ‘ক্লাইমেট ফিচার অব দ্য থান্ডারস্টর্ম ডেজ অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম ফ্রিকোয়েন্সি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা করেছেন আবহাওয়াবিদ সমরেন্দ্র কর্মকার। তিনি বলেন, জলীয় বাষ্পের সঙ্গে আদ্র৴তার একটি মেলবন্ধন ঘটে মেঘ সৃষ্টি হয়। সেটি ঘটছে না। তবে কয়েক দিনের অপেক্ষার পর বাংলাদেশে ঝড়বৃষ্টি শুরু হতে পারে বলে মনে করেন এই আবহাওয়াবিদ। আর তখন বজ্রঝড়ের মাত্রা অনেকটা প্রবল হতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম ও সমরেন্দ্র কর্মকারের মিলিত অভিমত, মাত্রাতিরিক্ত তাপই দায়ী বজ্রঝড় কম হওয়ার। আর এর কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা।
[তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন শাহ আলম, প্রতিনিধি, চুয়াডাঙ্গা]