অক্টোবর মাসে এত বৃষ্টি আর কবে হয়েছিল

বাংলাদেশের আবহাওয়ার তথ্য বলছে, অক্টোবর মাসে এমন বৃষ্টি আগেও হয়েছে। কখনো কখনো এর চেয়ে বেশি বৃষ্টিও হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো ফাইল ছবি

‘যাবার আগে কিছু বলে গেলে না, নীরবে শুধু রইলে চেয়ে’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এই গানটা অনেকেরই পরিচিত। অক্টোবরের এই শুরুতে, মৌসুমি বায়ু যাব যাব করার সময়। কিন্তু এই বায়ু বিদায় নেওয়ার আগে নীরব রইল না। ‘শেষ গানের রেশ’ বৃষ্টি হয়ে ঝরিয়ে গেল।

কিন্তু এ তো হালকা বৃষ্টি নয়। রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব এলাকায় তিন দিন ধরে প্রবল বৃষ্টি হতে দেখা গেছে। বৃষ্টির তোড়ে রাজশাহী নগরীর পথে জমেছিল পানি। যেন ছোটখাটো নদী। সেই পানিতে মাছ ধরার জন্য উৎসাহী মানুষ জাল ফেলেছিল। ময়মনসিংহে বৃষ্টির রেকর্ড হয়েছে।

বছরের এ সময়ে এমন বৃষ্টি কি খুবই অস্বাভাবিক? বাংলাদেশের আবহাওয়ার তথ্য বলছে, এ সময়ে এমন বৃষ্টি আগেও হয়েছে। কখনো কখনো এর চেয়ে বেশি বৃষ্টিও হয়েছে। প্রশ্ন হলো, শিউলি–ঝরা আশ্বিনে এত বৃষ্টি কেন হয়?

আরও পড়ুন

শুরুতেই বলেছি, এখন মৌসুমি বায়ুর বিদায় নেওয়ার সময়। শীত আসি আসি করছে। এ সময় পশ্চিমা বাতাসের সঙ্গে কুবের বাতাসের একটা সংঘাত হয়। আবহাওয়া একটু টালমাটাল অবস্থায় থাকে।

কোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যা কি না খুবই স্বাভাবিক। এই সংঘাতে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা বায়ু জয়ী হয়, বিদায় হয় পুবালি বাতাস। এই টালমাটাল অবস্থার পরিণতিই প্রবল বৃষ্টি। দেশের ইতিহাসে অক্টোবর মাসে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে অন্তত ৯ বার। দেখা গেছে, এই ৯ বারের মধ্যে তিনবারই সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে ময়মনসিংহে।

সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলছিলেন, খেয়াল করলে দেখা যাবে যে এই সময়টাই বেশি বৃষ্টি হয় দেশের উত্তরাঞ্চলে কিংবা ময়মনসিংহ অঞ্চলে। এদিকটায় পশ্চিমা লঘু চাপের বর্ধিত অংশ সক্রিয় থাকে। পুবালি বাতাসের সঙ্গে সংঘাতের ক্ষেত্র এই স্থানগুলোই। তাই বৃষ্টি বেশি হয় এসব অঞ্চলে।

গতকাল বৃহস্পতিবার দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় ময়মনসিংহে ৩৭৮ মিলিমিটার। দেশের ইতিহাসে অক্টোবরে মাসে রেকর্ড হওয়া বৃষ্টির দিক থেকে এই বৃষ্টি তৃতীয় সর্বোচ্চ। ১৯৭১ সালের ২ অক্টোবর ময়মনসিংহে বৃষ্টি হয়েছিল ৩৮১ মিলিমিটার। দেখা গেছে, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বড়জোর ১০ তারিখের মধ্যেই প্রবল বৃষ্টি হয়।

আরও পড়ুন

এ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, মৌসুমি বায়ু অক্টোবরের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই মোটামুটি বিদায় নেওয়ার অবস্থায় চলে যায়। বৃষ্টির দাপট তাই এই সময়ে বাড়ে।

আবার অক্টোবর ও নভেম্বর ‘ঘূর্ণিঝড়প্রবণ’ মাস হিসেবে পরিচিত। দেশে সাধারণত মৌসুমি বায়ু আসার আগে এবং চলে যাওয়ার পর ঘূর্ণিঝড় হয়। মৌসুমি বায়ু আসার আগে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে ঘূর্ণিঝড় হয়। আবার চলে যাওয়ার পর অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. আবুল কালাম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, ১৮৯১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৬২০টি ঘূর্ণিঝড় ও অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। আর নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে ৯৪১টি। ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অক্টোবর মাসে হয়েছে ২৫৫টি, নভেম্বরে ২১৯ ও ডিসেম্বরে ১০৫টি। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অক্টোবরে ৪২টি, নভেম্বরে ৭৪ ও ডিসেম্বরে ২৮টি হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর চলতি অক্টোবর মাসের যে পূর্বাভাস দিয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, দু–তিনটি লঘুচাপ ও একটি নিম্নচাপ হতে পারে। সেই নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। আবহাওয়াবিদদের মতে, এবারের বৃষ্টি সাগরে তৈরি হওয়া লঘুচাপ এবং মৌসুমি বায়ুর প্রভাবেই হয়েছে।

টানা বৃষ্টিতে ময়মনসিংহ নগরের বেশির ভাগ সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। আজ শুক্রবার সকালে ময়মনসিংহ নগরের ভাটিকাশর বড়বাড়ি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৮৯১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অক্টোবর মাসে সাগরে এ পর্যন্ত নিম্নচাপ হয়েছে ১২৯টি, নভেম্বরে ৭১ ও ডিসেম্বরে ৪৫টি।

এ মাসে তবে কি টানা বৃষ্টির এখানেই পরিসমাপ্তি?—এমন প্রশ্নের জবাবে আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, এ মাসে আরেকটি নিম্নচাপের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেটা যদি না হয়, তবে এইবারের মতো টানা বৃষ্টি এ মাসে আর হবে না।

বৃষ্টিতে শীতকালীন কৃষির ওপর প্রভাব

বাজারে এখন কিছু কিছু শীতকালীন শাকসবজি আসা শুরু হয়েছে। এগুলো বাস্তবে শীতের সাক্ষ্য সবজির বৈশিষ্ট্য বহন করে না। এগুলোকে কৃষিবিদেরা বলে থাকেন অফ সিজন ভ্যারাইটি। শীতকালীন শাকসবজির আবাদ শুরু হয় সাধারণত মধ্য অক্টোবরে।

কৃষিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায় বলেন, যাঁরা শীতকালীন শাকসবজির জন্য খেত প্রস্তুত করছেন, তাঁদের ক্ষতি হতে পারে এই বৃষ্টিতে। এ ছাড়া এখন ধান আছে খেতে, যেসব ধানে ফুল এসে গেছে, সেসব ধানের হয়তো খুব বেশি ক্ষতি হবে না। তবে টানা বর্ষণে বন্যার সৃষ্টি হলে আমনের ক্ষতি রোধ করা যাবে না।

শীতের ফলের মধ্যে পেঁপে এবং কলা অন্যতম। কৃষিবিষয়ক লেখক মৃত্যুঞ্জয় রায় মনে করেন, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে এই দুই ফলেরও ক্ষতি হবে।