বুনো আঙুরের গল্প
অফুরন্ত অবসর। তাই আমেরিকার পিটসবার্গ শহরের রাস্তায় মাঝেমধে৵ হাঁটতে বের হই। পুরো শহরটাই পাহাড়ি। তাই চড়াই ভেঙে ওপরে উঠতে খানিকটা কষ্ট হয়। তবু সেই কষ্ট ভুলে যাই, যখন স্কুইরেল হিলের গা বেয়ে বুনো ঝোপঝাড়ে অনেক ফুল ও ফল ধরা গাছ দেখি। কেউ ওগুলো লাগায়নি, গাছগুলো আপনা–আপনি জন্মেছে। প্রায় কোনো গাছই চিনি না। চোখে ভালো লাগলে সেসব গাছের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ি আর চেহারা-সুরত ও স্বভাব খানিকটা দেখার চেষ্টা করি।
নানা রকম গাছের মধ্যে হঠাৎ একটি গাছ চোখে পড়ল আঙুরের লতার মতো দেখতে, পাতাগুলোও আঙুরের মতো। ফলগুলোও আঙুরের মতো থোকা ধরেছে; কিন্তু ফলগুলো আঙুর না, দেখতে যেন সেগুলো চিনামাটির ফলের মতো লাগছে, আকার আঙুরের চেয়ে অনেক ছোট, অনেকটা চটপটির ডালের দানার মতো। অদ্ভুত তার রং। কাঁচা ফলগুলো সাদাটে, লতার গিঁটে গিঁটে সরু সরু বোঁটায় অসংখ্য ফল ধরে রয়েছে। পাকতে শুরু করা ফলগুলোর রং নীলাভ, পরে হয় বেগুনি ও শেষে কালচে বেগুনি। একই থোকায় নানা রঙের ফল।
ফলগুলো সুগোল, খোসা মসৃণ, খোসার গায়ে অস্পষ্ট কালো বিন্দু বিন্দু দাগ রয়েছে, যা ভালো করে খেয়াল না করলে দেখা যায় না। লম্বা সরু লতা, জড়িয়ে–পেঁচিয়ে অন্য গাছগুলো আঁকড়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। যেন ওটাই তার রাজত্ব, সে রাজ্যের সেই-ই রাজতরু, অন্যরা যেন প্রজা। ওকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য মাথা গুঁজে পাহাড়ের ঢালে পড়ে রয়েছে ওরা। সেসব আশ্রয়দাতা গাছ ছোট হলে তো কথাই নেই, ওগুলোর ঘাড়ের ওপর দিয়ে চাদরের মতো নিজেদের ডালপালা ও লতাপাতা বিছিয়ে ঘন ছায়াময় করে ফেলে। সেসব ঝোপঝাড় অনেক পাখি, প্রাণী ও পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। স্তন্যপায়ী অনেক প্রাণী ও পাখি এর ফল খায় ও দূরবর্তী স্থানে সেসব বীজ ছড়ায়। ফলে এ গাছের বংশ বাড়াতে কোনো অসুবিধা হয় না। বনের প্রান্তে, পাহাড়ের পাদদেশে, জলাশয়ের ধারে এ গাছ সাধারণত বন্যভাবে জন্মাতে দেখা যায়।
আমেরিকায় শীতের আমেজ শুরু হলেই ফলগুলো পাকতে শুরু করে, এরপর আসে পাতা ঝরার পালা। শীত এলে সম্পূর্ণ পাতা ঝরে সে গাছ ন্যাংটা হয়ে যায়। কাঠের মতো শক্ত লতাগুলো মুখ বুজে শীত ও বরফের দাপট সহ্য করে টিকে থাকে। এরপর বসন্তে আবার পাতা ফুলে হেসে ওঠে, সেসব গাছে জুলাই বা গ্রীষ্মের মাঝামাঝি ফুল ফোটে ও ফল ধরা শুরু হয়। আগস্ট–সেপ্টেম্বরে ফল ধরে। ছোট থোকায় অনেকগুলো সবুজাভ সাদা রঙের ক্ষুদ্র ফুল ফোটে। ফল প্রায় সিকি ইঞ্চি আকারের।
মনোহারী এ গাছের ইংরেজি নাম আমুর পেপারভাইন। ফলগুলোর কথা ভেবে এর আর এক নাম রাখা হয়েছে পোরসেলিন বেরি। এ গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Ampelopsis brevipedunculata ও গোত্র ভিটেসি। অর্থাৎ গাছটা আঙুরগোত্রীয়, একধরনের বুনো আঙুর, ফল খাওয়া যায় না। এর গণগত নামের প্রথম অংশ গ্রিক শব্দ অ্যামপেলোস অর্থ লতা এবং ওপসিস অর্থ সদৃশ, শেষ নামাংশের অর্থ ফুলের খাটো বোঁটা। পাতা ও ফলগুলো আঙুরসদৃশ।
আমুর পেপারভাইন কাষ্ঠল বহুবর্ষজীবী লতানো গাছ। লতা ছয় মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। লতার গিঁট থেকে পাতা ও আকর্ষি জন্মে। আঙুরের সঙ্গে এর আর একটি বৈশিষ্ট্যে প্রভেদ রয়েছে। আঙুরগোত্রীয় গাছ অন্য অবলম্বন বা গাছকে আঁকড়ে ধরে তার আকর্ষির সাহায্যে। এ গাছেরও আকর্ষি আছে। তবে আঙুরলতার আকর্ষি শাখান্বিত নয়, এর আকর্ষি শাখান্বিত। গিঁটে অনেক ফুটকি ফুটকি বায়ুরন্ধ্র বা লেন্টিসেল দেখা যায়। পাতা আঙুরের মতো, হৃৎপিণ্ডাকার ও কিনারা করাতের মতো খাঁজকাটা। কোনো কোনো পাতার কিনারা গভীরভাবে খাঁজকাটা থাকে। পাতায় সাধারণত তিনটি গভীর খাঁজ থাকে, রং সবুজ বা ফ্যাকাশে সবুজ। তবে পাতা আঙুরের পাতার চেয়ে ছোট।
গাছটির জন্মভূমি চীন ও জাপান হলেও এটি এখন আমেরিকার বাসিন্দা। আমেরিকানরা ১৮৭০ সালে বাহারি গাছ হিসেবে বাগানে লাগানোর জন্য সেসব দেশ থেকে এ গাছ নিয়ে এসেছিল; কিন্তু অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে এটিকে আর তাদের লাগাতে হচ্ছে না। আগ্রাসী আগাছার মতো পাহাড়ে, বনে-জঙ্গলে ও শহরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। যাদের বাগানভূমি তরু–আচ্ছাদিত করা দরকার, তাদের জন্য এই গাছ অতুলনীয়। একবার লাগালে সেখানে বাঁচে অনেক বছর আর দ্রুত সেসব অসুন্দর জায়গা লতাপাতায় ঢেকে ফেলে। কি বালু, কি কাঁকুরে-পাথুরে মাটি—সব স্থানেই এই বুনো আঙুরের গাছ বিনা যত্নে জন্মে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক