টিকে থাকুক বিরল পাখিটি
আজ থেকে ১৭১ বছর আগে (১৮৫২) ভারতের ৩৮ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন রবার্ট সি টিটলার ঢাকা সফরে এসে বিভিন্ন বন্য প্রাণী পর্যবেক্ষণ করেন, যা ১৮৫৪ সালে দ্য অ্যানালস অব ম্যাগাজিন অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে প্রকাশিত হয়।
গবেষক হারুন-উর-রশিদ-এর ‘সিস্টেমেটিক লিস্ট অব বার্ডস অব ইস্ট পাকিস্তান (১৯৬৭)’-এ টিটলারের প্রবন্ধে উল্লিখিত অতি বিরল জলজ পাখিটির উল্লেখ ছিল। কিন্তু দীর্ঘ ১৬৭ বছর পর গত ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯-এ ক্যাপ্টেন টিটলারের দেখা অধরা জলজ পাখিটি প্রথমবারের মতো ধরা দিল রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক নূর-ই-সৌদ-এর ক্যামেরায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাবুডাইংয়ে। ওই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাখিটির খোঁজে বাবুডাইংয়ে গেলাম।
বাবুডাইংয়ে পৌঁছেই পাখিটিকে খুঁজতে একটি সর্পিল খাঁড়ির দিকে ছুটলাম। ঘণ্টাখানেক খুঁজে না পেয়ে জায়গা বদলে উল্টো দিকের পেয়ারাবাগানে গিয়ে খাঁড়িতে উঁকি দিলাম। ডাহুকের মতো কিছু একটা যেন পানি থেকে ঝোপের দিকে সরে গেল। হয়তো অধরা পাখিটি! খাঁড়ির সঠিক অবস্থান নিশ্চিত হতে পক্ষী আলোকচিত্রী মারুফ রানাকে ফোন দিলাম। সব শুনে ও বলল, এটা সেই জায়গা না। অপেক্ষা করেন, আধঘণ্টার মধ্যে আসছি। মারুফ আসতেই জায়গামতো গেলাম। বাহ্ চমৎকার, এখানে এ রকম সুন্দর জায়গাও আছে!
এক জায়গায় না থেকে আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান নিলাম। আমি টিলার মতো উঁচু স্থানে একটি বড় গাছের আড়ালে বসলাম। সেখান থেকে সর্পিল খাঁড়িটি ভালোই দেখা যাচ্ছে।
অসহ্য গরমে ঘণ্টাখানেক বসে থেকে সবাই ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত। বেলা ২টা ৪০ মিনিটে খাঁড়িতে কিছু একটা নড়তে দেখলাম যেন! ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখতেই খুশিতে মনটা নেচে উঠল। পাখিটি স্পষ্টভাবেই দেখলাম! আমার চোখ আটকে গেল ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে, কিন্তু আঙুল অজান্তেই শাটারে ক্লিক করে গেল।
এত বছর পর পুনরাবিষ্কৃত পাখিটি এ দেশের অতি বিরল আবাসিক পাখি ‘কাগ’। বাদামি ঘুরঘুরি বা খেনি নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম ব্রাউন ক্রেক বা বুশ-হেন। গোত্র রেলিডি; বৈজ্ঞানিক নাম Zapornis akool। কাগের দুটি উপপ্রজাতি রয়েছে; একটি উত্তর-পূর্ব পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ও পশ্চিম মিয়ানমার এবং অন্যটি দক্ষিণ-পূর্ব চীন থেকে উত্তর-পূর্ব ভিয়েতনাম পর্যন্ত বিস্তৃত।
কাগ ছোট আকারের জলমুরগিজাতীয় পাখি। লম্বায় ২৫ থেকে ২৮ সেন্টিমিটার। ওজন ১১০ থেকে ১৭০ গ্রাম। স্ত্রী পাখি পুরুষটির চেয়ে কিছুটা ছোট। পুরো দেহের পালক জলপাই বাদামি। চিবুক ও ঘাড় সাদাটে, যা কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে দেহের নিচের দিকে ধূসরাভ রঙে নেমে গেছে। বুক-পেট ও দেহের পাশ কিছুটা বাদামি। চোখ গাঢ় লাল। নিচের ঠোঁট এবং ওপরের ঠোঁটের গোড়ার দিকের কিছু অংশ হলদে সবুজ; ওপরের ঠোঁটের বাকি অংশ জলপাই ধূসর ও আগা নীলচে ধূসর। লম্বা পা ও আঙুল বাদামি ধূসর। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির চোখ বাদামি।
জলাভূমি, গভীর জলাশয়, নলখাগড়া ও ধানখেতে এ পাখি দেখা যায়। খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি ছাড়া দূরে যায় না। সান্ধ্যচারী পাখিগুলো একাকী বা জোড়ায় থাকে। এরা কীটপতঙ্গ, অমেরুদণ্ডী প্রাণী, ছোট ব্যাঙ, ঘাস, শিকড়, বীজ, ছোট ফল ইত্যাদি খায়।
প্রজননসংক্রান্ত তথ্য কম। তবে মার্চ থেকে আগস্টে প্রজনন করে বলে জানা যায়। স্ত্রী মাটিতে ঘন উদ্ভিদের মধ্যে ঘাস, কাঠি ও পাতা দিয়ে বাসা বানায়। ১০টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে।
বাবুডাইংয়ে এ পর্যন্ত এক জোড়া পাখি দেখা গেছে। সম্প্রতি মুঠোফোনে কথা হলো ডা. নূর-ই-সৌদের সঙ্গে। তিনি বললেন, প্রথমবার দেখার পর প্রতিবছরই ওগুলো দেখেছেন। এখন কথা হলো, পাখিজোড়ার আয়ু শেষ হয়ে গেলে কী হবে? ওগুলো কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে?
দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো, পাখি দুটির মধ্যে একটির পিঠের কিছু পালক সাদা। অর্থাৎ পাখিটি অন্তঃপ্রজননসংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছে, যা প্রজাতিটির অস্তিত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। তবে আশার কথা, বাবুডাইং ছাড়াও সম্প্রতি শেরপুর জেলার গারো পাহাড়েও এ পাখি দেখা গেছে।
বেশ কয়েকজন আলোকচিত্রী এর ছবিও তুলেছেন। ছবিগুলো পরীক্ষা করে দেখেছি, পালকের রং ঠিক আছে। তবে এত বছর পর পুনরাবিষ্কৃত হয়েও যদি আমাদের অবহেলায় এসব পাখি এ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? যদিও দেরি হয়ে গেছে, তবু এ পাখি সংরক্ষণের জন্য এখনই নিবিড় গবেষণা প্রয়োজন।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি, বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ