সেন্ট মার্টিনকে মেরে ফেলা হচ্ছে
পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে।
৩৮ বছরের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। কমেছে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা।
দ্বীপটিতে স্থাপনা নির্মাণ অবৈধ। তবে হোটেল, রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁ হয়েছে ২৩০টির বেশি। দুই বছরে তৈরি হয়েছে ১৩০টি।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে জাহাজ থামানোর ঘাট বা জেটি তৈরি হয়েছে দ্বীপটির পূর্ব পাশে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জেটি থেকে কিছু দূরের পশ্চিম সৈকতে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে তিনতলার তিনটি ভবন নিয়ে গড়ে উঠেছে আটলান্টিক রিসোর্ট নামের একটি স্থাপনা। দুটি ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে গত নভেম্বরে। একটি ভবনের নির্মাণকাজ এখনো চলছে।
আটলান্টিক রিসোর্টের আঙিনায় দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা যায়, সেখানে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা আছে যে দেশের ১৩টি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) একটি সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। মানে হলো, এ দ্বীপের পানি, মাটি, বায়ু বা প্রাণীর ক্ষতি করে, এমন কোনো কাজ সেখানে করা যাবে না। এ কারণে সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণে ছাড়পত্র দেয় না পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু আটলান্টিক রিসোর্টটি ছাড়পত্র ছাড়া সবার সামনেই নির্মিত হয়েছে।
এটা কীভাবে সম্ভব হলো, জানতে চাইলে আটলান্টিক রিসোর্টের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সোলেমান প্রথম আলোকে বলেন, দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে ৪০টির বেশি বহুতল ভবনের (দুই ও তিনতলা) হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে। সেগুলো যেভাবে নির্মিত হয়েছে, আটলান্টিক রিসোর্টও সেভাবেই হয়েছে।
দ্বীপটিতে প্রকাশ্যে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে হোটেল-রিসোর্ট। জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর দেখেও দেখে না।
সোলেমান যে দাবি করেছেন, তা ভুল নয়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে অনেকগুলো বহুতল ভবন রয়েছে। বহুতল ও একতলা মিলিয়ে সেখানে হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ ও রেস্তোরাঁর সংখ্যা ২৩০টির বেশি। এর মধ্যে গত দুই বছরে তৈরি হয়েছে অন্তত ১৩০টি। এখন নির্মাণকাজ চলছে ৩০টির বেশি রিসোর্ট ও কটেজের। পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, একটি পর্যটন স্থাপনা নির্মাণেও তাদের ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি।
অতীতে যা হওয়ার হয়েছে, এখন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আর একটি স্থাপনাও নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না।মো. হাফিজুর রহমান, উপপরিচালক,পরিবেশ অধিদপ্তর, কক্সবাজারের
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ঠেকানোর কাজটি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে দ্বীপটিকে রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। কক্সবাজারে জেলা প্রশাসন ও টেকনাফে উপজেলা প্রশাসনের কার্যালয় রয়েছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপেই পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি কার্যালয় আছে, পুলিশ ফাঁড়ি আছে। কিন্তু সবার চোখের সামনে দ্বীপটিতে নির্মাণসামগ্রী নেওয়া হয়, নির্মাণকাজ চলে, হোটেল ও রিসোর্ট উদ্বোধন হয়, পর্যটকেরা যান, দারুণ ব্যবসা হয়—কিন্তু কেউ বাধা দেয় না।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে যা হওয়ার হয়েছে, এখন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আর একটি স্থাপনাও নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সেন্ট মার্টিন নিয়ে এ ধরনের বক্তব্য অতীতেও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্থাপনা নির্মাণ ঠেকানো যায়নি।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গলাচিপা থেকে দিয়ারমাথা পর্যন্ত তিন বর্গকিলোমিটার এলাকায় পর্যটকদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ। কারণ, সেখানে কচ্ছপ ডিম পাড়তে যায়। এই নিষিদ্ধ এলাকায়ও ৩০টির বেশি দোতলা রিসোর্ট ও কটেজ নির্মাণ করা হচ্ছে।
দ্বীপটি অনন্য
দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত। আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরিপ দল এই দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে। জরিপে দ্বীপটির নামকরণ করা হয় সাধু মার্টিনের নামানুসারে।
সেন্ট মার্টিনে প্রবাল, শৈবাল, কাছিম, শামুক, ঝিনুক ও কড়ি, সামুদ্রিক মাছ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কাঁকড়াসহ ১ হাজার ৭৬ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কাছিমের ডিম পাড়ার স্থান এই দ্বীপের বালিয়াড়ি। তবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, বিপুলসংখ্যক পর্যটকের গমন ও পরিবেশদূষণের কারণে দ্বীপটি সংকটাপন্ন হয়েছে। পর্যটন মৌসুমে টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে ১১টি জাহাজে দিনে প্রায় পাঁচ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিনে যান। দ্বীপে যত্রতত্র ময়লা, আবর্জনা, প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট ও হোটেল-রেস্তোরাঁর বর্জ্য ফেলা হয়। বড় উদ্বেগের দিক হলো, দ্বীপে কেয়াবন উজাড় করে হোটেল-রিসোর্ট নির্মিত হচ্ছে।
২০২০ সালে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. কাউসার আহাম্মদ, ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক মো. ইউসুফ গাজী ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী তাহরিমা জান্নাতের এক গবেষণায় উঠে আসে, ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সাড়ে চার বর্গকিলোমিটার থেকে কমে নেমেছে তিন বর্গকিলোমিটারে। আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নালে ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়, ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হতে পারে।
পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকায় পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে দ্বীপটিকে ইসিএ ঘোষণা করে। সর্বশেষ গত ৪ জানুয়ারি বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী সেন্ট মার্টিন দ্বীপসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। এরপর জনপ্রিয় হলিউড তারকা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও এর জন্য বাংলাদেশ সরকার, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও বেসরকারি সংস্থাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এর আগে ২০১৬ সালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা জারি করা হয়। এই বিধিমালার অধীনে গঠিত প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা জাতীয় কমিটির সভাপতি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব।
জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব ফারহিনা আহমেদ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবৈধভাবে যেসব স্থাপনা সেন্ট মার্টিন দ্বীপে হচ্ছে, সেগুলো উচ্ছেদের জন্য আমরা কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (কউক) নির্দেশ দিয়েছি।’ তিনি জানান, দ্বীপটিকে রক্ষায় একটি নির্দেশিকাও তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে পর্যটকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় যে খসড়া নির্দেশিকা তৈরি করেছে, তা নিয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। তিনি ওই দিন প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষে নিয়মিত সেন্ট মার্টিন দ্বীপে গিয়ে অবৈধ স্থাপনা ও অন্যান্য অনিয়মের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানো সম্ভব নয়। তাঁর প্রস্তাব পরিবেশ অধিদপ্তরের স্থায়ী জনবল ও কার্যালয় সেখানে থাকতে হবে। যাতে তাঁরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে পারে।
পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন যখন একে অপরকে দায়দায়িত্ব নিতে বলছে, তখন সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বেড়েই চলছে। গত ৭, ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি এবং আরেক দফায় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখা যায়, নির্জন সৈকতের বালিয়াড়ি ও কেয়াবন উজাড় করে অবকাঠামো তৈরি, গভীর রাত পর্যন্ত সংরক্ষিত এলাকায় আলোকসজ্জা, লোকজনের হইচই এবং জেনারেটরের বিকট শব্দে ডিম পাড়তে আসতে পারছে না মা কচ্ছপ। এলেও কচ্ছপের ডিম খেয়ে নেয় কুকুর।
সৈকতের বালুচর দিয়ে পর্যটকবাহী ইজিবাইক (টমটম) ও মোটরসাইকেল চলাচল করে। ফলে শামুক, ঝিনুক, লাল কাঁকড়াসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।
দ্বীপের পরিবেশকর্মী জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত ডিসেম্বর থেকে সৈকতে মা কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে। এ মৌসুমে কচ্ছপ তেমন একটা চোখে পড়েনি। এটা অশনিসংকেত।
ছাড়পত্র ছাড়াই দোতলা-তিনতলা ভবন
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে জাহাজ থামানোর জেটির প্রায় ৭০০ গজ উত্তরে তিনতলা আবাসিক হোটেল ব্লু মেরিন। হোটেলটিতে কক্ষ আছে ৫৫টির বেশি। ভাড়া কক্ষের ধরনভেদে ৪ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা। হোটেলের মালিক চাঁদপুরের নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী।
সূত্র জানায়, ১৯৯০ সালে তিনি ৪১ শতক জমি কেনেন। ২০০৩ সালে সেই জমিতে নির্মাণ করেন হোটেলটি। তাঁর মৃত্যুর পর সন্তান আবু জাফর পাটোয়ারী সেটি দেখাশোনা করছেন।
সরকারি আইন অমান্য করে হোটেল নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে আবু জাফর পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে সময় হোটেল তৈরি করেছিলাম, তখন কোনো নীতিমালা ছিল না। এখন নানা অজুহাতে হয়রানি চলছে।’ উল্লেখ্য, হোটেলটি নির্মাণের চার বছর আগেই সেন্ট মার্টিনকে ইসিএ ঘোষণা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
ব্লু মেরিনের উত্তর পাশে তিনতলা হোটেল ফ্যান্টাসি। এটির মালিক চাঁদপুরের জাফর আহমদ। হোটেলটির ব্যবস্থাপক আরাফাতুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর হোটেলের পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়নি। কিন্তু তাঁরা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মেনেই হোটেলটি তৈরি করেছেন।
দ্বীপের পশ্চিম সৈকতে জমি কিনে তিনতলার কিংশুক হোটেল নির্মাণ করেছেন ঢাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সরোয়ার। এটিরও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। সরোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোই দ্বীপে বড় বড় ভবন তৈরি করেছে এবং করছে। তারা যদি পারে, ব্যবসায়ীরা কেন পারবেন না। আইন সবার জন্য সমান।
সরোয়ারের দাবিটিও মিথ্যে নয়। সরকারি কয়েকটি সংস্থা সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ভবন ও কটেজ করেছে। এসব কটেজে ওই সব সংস্থার কর্মকর্তারা রাতযাপন করতে পারেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়া হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, সরকারি সংস্থাও ভবনের ক্ষেত্রে তাদের ছাড়পত্র নেয়নি।
ভ্রমণনিষিদ্ধ এলাকায়ও রিসোর্ট
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গলাচিপা থেকে দিয়ারমাথা পর্যন্ত তিন বর্গকিলোমিটার এলাকায় পর্যটকদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ। কারণ, সেখানে কচ্ছপ ডিম পাড়তে যায়। এই নিষিদ্ধ এলাকায়ও ৩০টির বেশি দোতলা রিসোর্ট ও কটেজ নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে গোধূলি, দীপান্বিতা, দ্বীপান্তর, জ্যোৎস্নালয়, সিংসুক, সায়েরী, স্যান্ডক্যাসল, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, সূর্যবান, বেলা ভিসতা, সানসেট, সেরেনিটি, সিন্দাবাদ উল্লেখযোগ্য।
সেন্ট মার্টিনের জেটি থেকে ভ্রমণনিষিদ্ধ এলাকার রিসোর্টগুলোতে পর্যটকের যাতায়াতে চলাচল করে শতাধিক ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটম)। রয়েছে মোটরসাইকেল ও নৌযান। সেসব যানবাহনে চড়ে পুলিশের সামনে দিয়ে পর্যটকেরা নিষিদ্ধ এলাকায় প্রকাশ্যেই যান। বাধা দেওয়া হয় না কেন, জানতে চাইলে ট্যুরিস্ট পুলিশের সেন্ট মার্টিনের পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, দ্বীপে ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যসংখ্যা ১২। এত কম জনবল দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের হোটেল-রিসোর্টে রোহিঙ্গা তরুণ ও শিশু-কিশোরেরা কাজ করে। তারাই ব্যাটারিচালিত বেশির ভাগ ইজিবাইক চালায়। অভিযোগ আছে, মালিকেরা তাদেরও কাজে নেন কম মজুরি দেওয়া যায় বলে। এটা অবৈধ ও এ নিয়ে স্থানীয় ব্যক্তিদের ক্ষোভ রয়েছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য নেচারের সমন্বয়ক (সেন্ট মার্টিন) ও দ্বীপের বাসিন্দা আয়াতুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ হোটেল, রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁয় কম বেতনে রোহিঙ্গাদেরও চাকরি দেন মালিকেরা। এতে স্থানীয় তরুণদের অনেকে কাজ পান না। পেলেও মজুরি কম পান।
স্থানীয়দের বাস ঝুপড়িতে
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কোনো ইটের ভাটা নেই। রড, সিমেন্ট ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী আসে ট্রলারে ৩৪ কিলোমিটার দূরের টেকনাফ সদর থেকে। নির্মাণসামগ্রী দ্বীপে নিতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসনের পূর্বানুমতি লাগে। কিন্তু নিয়মকানুন বাধা হতে পারেনি হোটেল-রিসোর্ট নির্মাতাদের সামনে। কিন্তু দ্বীপের সাধারণ মানুষ পাকা ঘর করতে পারেন না। তাঁদের বেলায় ঠিকই বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রশাসন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, দ্বীপে ৯৫৭টি ঘর রয়েছে। এর অর্ধেক ঝুপড়ি, যেগুলোর বেড়া ও ছাউনি পলিথিনের। ঝুপড়ির পাশ দিয়ে পর্যটকেরা সমুদ্রসৈকতে যাতায়াত করেন। এতে বাসিন্দাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা থাকে না।
পূর্ব পাড়ার জেলে সুলতান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, দ্বীপে বাঁশ, বেত, ছন, গোলপাতা ও টিন বিক্রি হয় না। টেকনাফ থেকে নির্মাণসামগ্রী কিনে আনতে হলে উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি লাগে। সাধারণ মানুষের পক্ষে অনুমতি পাওয়া কঠিন। তিনি বলেন, ‘তাই আমরা ঝুপড়িতে থাকি।’
‘তাঁরা অবৈধ সুবিধাভোগী’
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, সেন্ট মার্টিন রক্ষায় আইন আছে, বিধিবিধান আছে, নির্দেশনা জারি করা আছে, প্রশাসন আছে, পরিবেশ অধিদপ্তর আছে, পুলিশ আছে, কিন্তু সবার সামনে দ্বীপটি ধ্বংস হচ্ছে। জনগণের করের টাকায় কর্মকর্তারা বেতন পান, তাঁরা দায়িত্ব পালন করেন না। মাঝেমধ্যে অভিযান হয়, অল্প কিছু টাকা জরিমানা হয়, কিন্তু দোতলা, তিনতলা ভবন নির্মাণ বন্ধ হয় না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যে অবৈধ হোটেল-রিসোর্ট আছে, গড়ে উঠছে, এটা প্রশাসনের কারও অজানা নয়। তারা এগুলো হতে দেয়, কারণ এর অবৈধ সুবিধাভোগী তারা। মাঝেমধ্যে যে অভিযান চলে, সেগুলো মূলত লোকদেখানো। তিনি বলেন, সেন্ট মার্টিনকে রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। সেটা দেখা যাচ্ছে না।