এবার বছরটা শুরু হয়েছে পাখিশুমারি দিয়ে। জানুয়ারি মাসজুড়ে দেশের প্রায় ৩২টি এলাকায় হয়েছে পাখিশুমারি। বেশ কয়েকটি অঞ্চলে এ বছর এ কাজে যোগ দিয়েছি। পরিযায়ী পাখির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর ও উপকূলীয় এলাকায় গত বছরের চেয়ে পাখির সংখ্যা এবার কিছুটা বেড়েছে।
কিন্তু গত ২০ বছরের পাখির সংখ্যার তথ্য বিশ্লেষণ করলে গবেষক হিসেবে কোনোভাবেই আশাবাদী হতে পারি না। এক টাঙ্গুয়ার হাওরেই এই সময়ের মধ্যে পরিযায়ী পাখি কমেছে প্রায় ৩৯ ভাগ। আর আবাসিক জলচর পাখি কমেছে প্রায় ৬১ ভাগ।
হাকালুকি হাওরের এ অবস্থা আরও ভয়াবহ। পরিযায়ী পাখি, যারা দীর্ঘ ভ্রমণ করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায়, বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে তারা সংকটে আছে।
বাংলাদেশে আমাদের বন্য প্রাণীর প্রজাতির সংখ্যা এখন প্রায় ১ হাজার ১০০। এ রকম বন্য প্রাণীর সমাহার খুব কম দেশেই পাওয়া যায়। এ দেশে পাখি প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৭২১। অথচ সারা ইউরোপে ৫০০ প্রজাতির পাখি দেখা খুব কঠিন। বাংলাদেশে বন্য প্রাণীর অবস্থা কী, তা দেখার জন্য ২০১৫ সালে প্রকাশিত আইইউসিএনের লাল তালিকা দেখা যেতে পারে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১২৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী হুমকি বা বিলুপ্তির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ১৪ ভাগ। গত ১০০ বছরে প্রায় ৩১ প্রজাতির বন্য প্রাণী হারিয়ে গেছে, যা এ দেশের মোট বন্য প্রাণীর প্রায় ২ ভাগ। তবে বৈশ্বিক এই তালিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৪২ হাজার প্রজাতি হুমকির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ২৮ ভাগ।
মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া বন্য প্রাণী রক্ষা একেবারেই অসম্ভব। এমনকি সরকারিভাবেও কাজটি করা এখন বেশ দুরূহ। বাংলাদেশে প্রায় সরকার ঘোষিত ৫১টি সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে। এসব এলাকায় সরকারের সীমিত সম্পদ দিয়ে বন ও প্রাণী কিছুটা রক্ষা করার চেষ্টা চলছে। বন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ এখন আগের চেয়ে ভালো।
বাঘের সংখ্যা এ বনে বেড়েছে বলে গবেষকেরা বলছেন। পাশাপাশি হরিণের সংখ্যাও কিছুটা বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইচ্ছা করলেই একটি প্রজাতি সংরক্ষণে যে অবদান রাখা যায়, তার প্রকৃত উদাহরণ বাঘ ও সুন্দরবন। পাখির মধ্যে শকুনের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯৯ ভাগ কমে গেছে। কিন্তু গত ১০ বছরে বাংলাদেশে বন অধিদপ্তর আর আইইউসিএনের যৌথ উদ্যোগে এই পাখির সংখ্যা এখন হ্রাস পাওয়ার হার কমেছে এবং সংখ্যা অপরিবর্তিত আছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে মানুষ বনায়ন তৈরি করে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল রক্ষায় অবদান রাখছে। আমাদের দেশে এ ধরনের প্রবণতা মানুষের মধ্যে এখনো তৈরি হয়নি। তবে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার পিটাছড়ায় মাহফুজ রাসেল নামের একজন নিজ উদ্যোগে বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য তৈরিতে কাজ করে বেশ কয়েকটি প্রজাতি ফিরিয়ে আনার অনন্য নজির তৈরি করেছেন।
আমাদের দেশটা বৈশ্বিকভাবেই বন্য প্রাণীর আবাসস্থল সহায়ক। বন্য প্রাণীর প্রজনন হারও এ অঞ্চলে বেশ ভালো। বেশ কয়েকটি প্রাণীর সংরক্ষণে এখনই মনোযোগ না দিলে খুব দ্রুতই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এগুলো হলো বনের হাতি, কয়েক জাতের হনুমান ও বানর, মেছো বিড়াল, নদীর ঘড়িয়াল, ডলফিন ও উদবিড়াল, বেশ কয়েক জাতের পাখি যেমন শকুন, সুন্দরবনের সুন্দরী হাঁস, দেশি গাংচষা, চামুচঠুঁটো বাটান ও পালাসের কুড়া ইগল।
বন্য প্রাণী দিবস ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে। এ বছরও ঘটা করে দিবসটি পালন করা হবে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সকলের অংশগ্রহণ বন্য প্রাণী হবে সংরক্ষণ’। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণেই প্রকৃতিতে ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে বন্য প্রাণী। কাজটি এগিয়ে নিতে পারলে মানুষই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে।
সীমান্ত দীপু, বন্য প্রাণী গবেষক