বৃষ্টি যেন আর থামতেই চায় না; কিন্তু বৃষ্টির জন্য তো আর সময় থেমে থাকবে না। কাজেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই তিল্লিতালে অবস্থিত ভারতের নৈনিতাল চিড়িয়াখানার দিকে এগিয়ে গেলাম। চিড়িয়াখানার ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে চার-চারটি বিরল প্রজাতির পাখির দেখা পেলাম। নাহ, এগুলো চিড়িয়াখানার কোনো খাঁচার পাখি নয়, প্রাকৃতিকভাবে ঘুরে বেড়ানো বুনো পাখি।
চিড়িয়াখানার বিভিন্ন পাখি-প্রাণী দেখে একটি উঁচু জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। জায়গাটি এতই উঁচু যে হাত দিয়েই যেন মেঘ ধরা যায়! ক্রমে মেঘের আনাগোনা বাড়তে লাগল। পেঁজা তুলার মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। আচমকা একফালি মেঘের ফাঁক দিয়ে নাম না–জানা একটি গাছে একটি পাখিকে বসে থাকতে দেখলাম। প্রথম দেখাতেই পাখিটি চিনে ফেললাম; কিন্তু মেঘের কারণে কিছুতেই ওটির ছবি তুলতে পারছিলাম না। ক্রমে চারদিক কালো হয়ে আসতে লাগল। কাজেই কোনো রকমে তিন-চারটি সাক্ষী ছবি তুললাম। আফসোস, একটুও রোদ উঠল না। এত বিরল পাখিটি কাছে পেয়েও ওটির একটি ভালো ছবি তুলতে পারলাম না। ২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালের ঘটনা এটি।
নৈনিতাল চিড়িয়াখানায় দেখা পাখিটি এ দেশের বিরল আবাসিক পাখি পাহাড়ি বাউরি। বৃহৎ বা বড় বসন্তবাউরি নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে মহাবসন্তবাউরি। ইংরেজি নাম গ্রেট বারবেট। মেগালাইমিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Psilopogon virens। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বিস্তৃতি।
প্রাপ্তবয়স্ক পাহাড়ি বাউরির দেহের দৈর্ঘ্য ৩১ থেকে ৩৩ সেন্টিমিটার এবং ওজন ১৯২ থেকে ২৯৫ গ্রাম। এ দেশের সবচেয়ে বড় আকারের বসন্তবাউরিটির মাথা গাঢ় বেগুনি নীল। ঘাড়, গলা ও বুক গাঢ় বাদামি। ডানা ও লেজ সবুজ। গাঢ় জলপাই রঙের দাগছোপসহ দেহের নিচটা হলদে। চোখ গাঢ় বাদামি লাল। চঞ্চু হলদে, ওপরের চঞ্চুর আগা কালো। পা, পায়ের পাতা, আঙুল ও নখ কালচে। স্ত্রী ও পুরুষের চেহারা অভিন্ন। সবুজ মাথাসহ অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের পালক ফ্যাকাশে।
পাহাড়ি বাউরি চট্টগ্রাম বিভাগের উঁচু পাহাড়ি চিরসবুজ বন, ফলের বাগান ও উপত্যকায় বাস করে। সচরাচর একাকী, জোড়ায় বা ছোট দলে থাকে। খাদ্যের জন্য ফল ও ফুলের গাছে বিচরণ করে। পাকা ফল, ফুলের পাপড়ি, গুবরে পোকা, উইপোকাসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গ এ পাখির প্রিয় খাবার। ওড়ার সময় ডানা থেকে শিস দেওয়ার মতো শব্দ হয়। সচরাচর উচ্চ স্বরে পিউ-পিউ-পিউ-পিউ-পিউ... শব্দে ডাকে। আবার মাঝেমধে৵ কর্কশ কণ্ঠে ‘কে-ইয়াও...’ শব্দে ডাকে।
মার্চ থেকে জুন পাহাড়ি বাউরির প্রজননকাল। এ সময় ভূমি থেকে তিন থেকে পাঁচ মিটার উঁচুতে গাছের ডালে খোঁড়ল করে বাসা বানায়। অনেক সময় কাঠঠোকরার পরিত্যক্ত বাসা বা গাছের প্রাকৃতিক খোঁড়লও ব্যবহার করতে পারে। স্ত্রী দুই থেকে তিনটি সাদা রঙের ডিম পাড়ে। স্ত্রী ও পুরুষ মিলেমিশে ডিমে তা দেয় ও ছানাগুলো লালনপালন করে। ডিম ফোটে ১৩–১৫ দিনে। আয়ুষ্কাল ৮ থেকে ৯ বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান: পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিত্সাবিশেষজ্ঞ