কাঁচামিঠা আমের কড়চা
আমের রাজ্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে সাধারণত দুষ্টু বালকেরাও আমগাছে ঢিল ছোড়ে না। হাতের নাগালে আম থাকলেও পেড়ে নেয় না। কিন্তু চুল-দাড়ি পাকা একজন লোককে আমগাছে ঢিল ছুড়তে দেখে অবাকই হলাম। কয়েকবারের চেষ্টায় সফল হলেন তিনি। গাছ থেকে পাড়ার পর গাছে বাড়ি দিয়েই আম ফাটিয়ে খেতে খেতে হাঁটা ধরলেন। আম তখনো পাকেনি। তবে কেন এই ঢিল ছোড়াছুড়ি? এই জিজ্ঞাসা থেকে আমিও ঢিল দিয়ে একটি আম পাড়লাম। খেয়ে বুঝলাম, কেন এই আম বুড়ো লোকটিকে কিছু সময়ের জন্য হলেও বয়স ভুলিয়ে দুষ্টু বালক বানিয়েছে। আম তো নয়, যেন অমৃত!
কাঁচামিঠা আম নিয়ে এই গল্প শোনালেন আম ব্যবসায়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার রাজারামপুর মহল্লার আবদুল ওহাব (৪৩)। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের ছয়রশিয়ায় একটি বাগানের আম কিনতে গিয়ে কাঁচামিঠা আমের প্রতি মানুষের এই আকর্ষণের দৃশ্য দেখেছিলেন তিনি। তিনি বলেন, ছয় বছর আগে খাওয়া বেনামি ওই কাঁচামিঠা আমের স্বাদ তিনি এখনো ভুলতে পারেননি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের গাবতলা মোড়ে বরেন্দ্র কৃষি উদ্যোগ নামের কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের বিপণনকেন্দ্র ‘শুদ্ধ’তে বসে আবদুল ওহাব যখন এই গল্প করছিলেন, তখন সেখানে ছিলেন শুদ্ধের পরিচালক ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম (৪৮)। তিনি বলেন, কাঁচামিঠা আম নিয়ে সেখানকার চল্লিশ ও পঞ্চাশোর্ধ্ব অনেকেরই এমন স্মৃতি রয়েছে।
মুনজের আলম প্রথম আলোকে বলেন, দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, নানা বেনামি অনেক কাঁচামিঠা আমের জাত কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাণিজ্যিক জাতের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন আমচাষিরা। এর মধ্যে টিক্কাফরাস নামের আমটি কাঁচামিঠা জাত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তবে ফজলি, ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া, আম্রপালি, আশ্বিনা ও গৌড়মতি জাতের মতো টিক্কাফরাস জাতের কোনো আমবাগান নেই। কোনো বাগানে হয়তো দু-একটি গাছ রেখেছেন শৌখিন বাগানিরা।
একই কথা বললেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের (আম গবেষণা কেন্দ্র) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্যিক জাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি কাঁচামিঠার কোনো জাত। অনেক বেনামি কাঁচামিঠা জাতের আম হারিয়ে গেছে। কেবল নাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে টিক্কাফরাস। এই আম কাঁচা যেমন মিষ্টি, তেমনি পাকাতেও মিষ্টি।
২০১১ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) টিক্কাফরাস আমটি বারি আম-৯ হিসেবে অবমুক্ত করেছে। এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিক জাত হিসেবে আমটি প্রতিষ্ঠা পায়নি। তবে ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে, বিশেষ করে শিশুদের কাছে। ভালো দামও পাচ্ছেন চাষিরা। আমটির গড় ওজন ১৬৬ গ্রাম। মে মাসের শেষ দিকে বাজারে আসে। গায়ের রং সবুজ। আমের আঁশ সাদা। খেতে কচকচে। মিষ্টতা ১১ ভাগ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের সবচেয়ে বড় মোকাম শিবগঞ্জ উপজেলা। জেলার অন্য চার উপজেলায় যত আমগাছ আছে, তার থেকে বেশি আমগাছ আছে এই উপজেলায়। জাতবৈচিত্র্যেও এগিয়ে শিবগঞ্জ।
কাঁচামিঠা আম নিয়ে জানতে যোগাযোগ করেছিলাম শিবগঞ্জের বাসিন্দা ও আম গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ইউসুফ আলীর সঙ্গে। কয়েক দিনের অনুসন্ধানের পর তিনি বলেন, শিবগঞ্জে কাঁচামিঠা আমের বাগান নেই। তবে উপজেলার বিমর্ষী গ্রামে শৌখিন বাগানি হাজি এখলাস উদ্দীনের আমবাগানে কাঁচামিঠা আমের ১৬টি গাছ আছে।
ইউসুফ আলীর কাছে সন্ধান পেয়ে ১৬ মে যাই ওই বাগানে। সঙ্গে ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উপসহকারী উদ্যানতত্ত্ববিদ ফয়জুর রহমান। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, কয়েক বছরের জন্য বাগানটি ইজারা নিয়েছেন রবিউল ইসলাম (৪৮) নামের এক ব্যক্তি। সেখানে এক চায়ের দোকানে কথা হলো কয়েকজন আমচাষি ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে একজন সাদিকুল ইসলাম (৪০) জানান, সেখানে ৫০টি বাগান খুঁজলে কোনো একটি বাগানে হয়তো দু-একটি কাঁচামিঠা আমের গাছ পাওয়া যাবে।
কথা হলো রবিউল ইসলামের সঙ্গেও। তিনি জানান, এখলাস হাজি তাঁর বাগানের কাঁচামিঠা আমগাছগুলো আর রাখতে চান না। কেননা, এসব আমের বাজারমূল্য কম। তবে গত দুই বছর থেকে টাঙ্গাইলের একজন ব্যাপারী ভালো দাম দিয়ে সেখান থেকে কাঁচামিঠা আম কিনছেন। তাই গাছগুলোয় কাঁটা ঠেকিয়ে রেখেছেন তিনি।
বাবুল হোসেন নামের আরেক আমচাষি ও ব্যবসায়ী জানান, এ বছর পাঁচটি বাগানের আম কিনেছেন তিনি। এর একটিতেও কাঁচামিঠা আমগাছ নেই। অন্য আমচাষিরা জানান, শৈশবে কত কত দিন ঢিল ছুড়ে কাঁচামিঠা আম খেয়েছেন। এসব আলাপ শুনতে শুনতে হাজি এখলাস বাগানের পাশের চা-দোকানি ইউসুফ (২০) বলেন, ‘হামি তো প্রত্যেক বছরই এখলাস হাজির কাঁচামিঠা আমের বাগানের আম কুড়িয়্যাও খাই, ঢ্যাল মাইরা পাইড়াও খাই। তাই বইল্যা অন্য গাছে কিন্তু ঢ্যাল মারি না। হামারঘে দিককার ছ্যালাপিলারাও আমগাছে ঢ্যাল মারে না। আসলে ওই আমটার লোভ সামলাইতে পারি না তো, তাই ঢ্যাল মারি।’