বিরল লাল কাঞ্চনের দেখা

সাভার বরিশাল নার্সারিতে ফোটা লাল কাঞ্চন ফুল
ছবি: লেখক

রক্তের রং লাল। তাই রক্তকাঞ্চন ফুলটি প্রথম দেখার আগে কল্পনা করেছিলাম, ফুলটার রং লালই হবে। কিন্তু বাস্তবে একদিন যখন রমনা উদ্যানে নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা ঘুরে ঘুরে নানা পদের কাঞ্চনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, তখনই বুঝলাম, রক্তকাঞ্চন ফুলের রং আসলে লাল নয়,Ñঘন ম্যাজেন্টা।

ম্যাজেন্টা রঙের কাঞ্চন ফুলের নাম কী করে রক্তকাঞ্চন হলো, তা জানা নেই। হয়তো বাংলায় এর চেয়ে লাল আর কোনো কাঞ্চন ফুল নেই বলে এর নাম দেওয়া হয়েছিল রক্তকাঞ্চন (Bauhinia variegate)। আমরাও সে নাম মেনে নিয়েছি; যেভাবে আমরা আপন করে নিয়েছি নানা দেশ থেকে আসা কাঞ্চনের অন্য সহোদরদের।

কাঞ্চন ফ্যাবেসি অর্থাৎ শিম গোত্রের বাউহিনিয়া গণের গাছ। সারা বিশ্বে এ গণের ১৯৩টি প্রজাতির গাছ রয়েছে। বাংলাদেশে রয়েছে ১৭ প্রজাতির কাঞ্চনগাছ। আমরা সচরাচর দেখি বসন্তে ফোটা গোলাপি রঙের ফুলের দেবকাঞ্চন (Bauhinia purpurea) ও বর্ষা-শরতে ফোটা সাদা ফুলের শ্বেতকাঞ্চন (Bauhinia acuminata)। এ দুটি গাছ দেশের অনেক জায়গায় দেখা যায়। বসন্তে ফোটা হলুদ রঙের স্বর্ণকাঞ্চন বা হলুদ কাঞ্চন (Bauhinia tomentosa) খুব কম দেখা যায়।

সাভার মাশরুম সেন্টারের মধ্যে একটি হলুদ কাঞ্চনের গাছে এ বছর বসন্তেও ফুল ফুটতে দেখেছি। লতা কাঞ্চন (Bauhinia glabrifolia) ও কাঞ্চন লতা বা চেহুর (Bauhinia vahlii) গাছ আছে মধুপুর শালবনে। রাঙামাটির পাহাড়ে শরত-হেমন্তে ফুটতে দেখেছি গোলাপি ম্যাজেন্টা রঙের মিশেলে বন কাঞ্চন ফুল (Bauhinia malabarica)। কিন্তু দেশের কোথাও কখনো লাল কাঞ্চনের দেখা পাইনি।

গত বছর একদিন সত্যি সত্যি টকটকে লাল রঙের এক কাঞ্চন ফুলের দেখা পেলাম সাভারের বরিশাল নার্সারিতে। গ্রীষ্মের দিনে মাঝারি আকারের ঝোপাল গাছের দোলায়মান লতালু ডালপালা ভরে ফুটে ছিল অসংখ্য লাল কাঞ্চন ফুল (Bauhinia galpinii)। সেপ্টেম্বরেও দেখেছিলাম ফুটতে। অন্যান্য কাঞ্চনগাছের মতোই পাতা, উটের খুরের মতো দুটি গভীর খাঁজে বিভক্ত পত্রফলক। তবে পাতার আকার অন্যান্য কাঞ্চনের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ছোট ও ফ্যাকাশে সবুজ। ফুলের পাপড়ি দেখতে কিছুটা কৃষ্ণচূড়া ফুলের মতো হলেও এর সব পাপড়ির রং লাল। গাছ পাঁচ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। বেশ দ্রুত বাড়ে।

বরিশাল নার্সারির ব্যবস্থাপক মো. আলাউদ্দিন জানালেন, বছর পাঁচেক আগে তাঁরা লাল কাঞ্চনের ওই গাছটি এনেছিলেন থাইল্যান্ড থেকে। এরই মধ্যে গাছটি পাঁচ-সাত ফুট উঁচু হয়ে প্রচুর ডালপালা ছেড়ে ঝোপাল হয়ে উঠেছে। লাগানোর পর থেকে প্রতিবছরই প্রচুর ফুল ফুটছে সে গাছে। ফুল শেষে তা থেকে প্রায় চার ইঞ্চি লম্বা খাটো-চ্যাপ্টা শিমের মতো ফল হচ্ছে।

ঢাকার মিরপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনে ফোটা রক্তকাঞ্চন ফুল
ছবি: লেখক

তবে সব ফলের মধ্যে বীজ হয় না। তিনি জানালেন, বীজ ও নানা পদ্ধতিতে কলম করে বহুবার তাঁরা লাল কাঞ্চনের চারা তৈরির চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে একবার প্রায় দেড় শ বীজ বুনে তা থেকে মাত্র তিনটি চারা পেয়েছিলেন। সেসব চারা মাটিতে লাগানোর পর দুটি মরে গেছে, একটি বেঁচে আছে। কীভাবে এর চারা তৈরি করা যাবে, তা তাঁদের জানা নেই। তাই বারবারই ব্যর্থ হচ্ছেন।

লাল কাঞ্চনের আদি নিবাস দক্ষিণ–পূর্ব আফ্রিকা, তবে বিদেশি প্রজাতির লাল কাঞ্চন যে এ দেশের আবহাওয়া ও মাটিতে বেশ ভালোভাবে মানিয়ে গেছে, তা প্রমাণিত। সমস্যা হলো একটি থেকে আরেকটি গাছ জন্মানো যাচ্ছে না। লাল কাঞ্চনের বংশবৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা হতে পারে।

উদ্যানতত্ত্ববিদ ও গবেষকদের এই সবে ধন নীলমণি লাল কাঞ্চনের গাছটি থেকে চারা তৈরি করে এর সম্প্রসারণ করা উচিত। তাহলে এ দেশের কাঞ্চনভান্ডারে আরও একটি মণিকাঞ্চন যোগ হবে। এসেই যখন পড়েছে, তখন লাল কাঞ্চনকে এ দেশ থেকে হারানো ঠিক হবে না। লাল কাঞ্চন শুধু এ দেশেই নয়, সারা বিশ্বেই বিরল গাছ।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক