শিবসাপাড়ের প্রাচীন স্থাপনা
গহিন বন, চারদিকে ঘন গাছের সারি। সকালের রোদ আঁচল বিছিয়েছে সুন্দরবনের বুকে। সুন্দরবনের ভেতরের ছাচানাঙলা খাল ধরে ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি এগিয়ে চলেছে কালাবগী ফরেস্ট অফিসের দিকে। নিরাপত্তার জন্য সেখান থেকে উঠলেন বনপ্রহরী নজরুল ইসলাম। গন্তব্য গহিন সুন্দরবনের মধ্যে প্রাচীন স্থাপনার নিদর্শন ও গাবগাছের বাগান দেখা।
বনপ্রহরী নজরুল ইসলাম ২৫ বছর ধরে সুন্দরবনে চাকরি করছেন। দীর্ঘ জীবনের নানা অভিজ্ঞতা মেলে ধরলেন আলাপচারিতায়। তাঁর সঙ্গে গল্পের তালে তালে এগোতে থাকে নৌকা। ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি মিনিট বিশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেল সুন্দরবনের শিবসা নদীতে। নদীর দুই পাড়ে সবুজ-সুন্দর মনোরম সুন্দরবন। হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়, এমন দূরত্বে বানরের দল অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কিছু দূর গিয়ে নদীর পাড়ে নজর কাড়ল কিছুটা ব্যতিক্রম বন।
দূর থেকে দেখা গেল সুন্দরবনের মধ্যে পুরোনো ইটের স্তূপ আর আশপাশে বিশাল গাবগাছের বাগান। তীরে গিয়ে নৌকা থেকে নিচে নামতেই বুঝলাম, জোয়ারের পানির তোড়ে ছোট–বড় ছয়টি গাবগাছ শিকড় উপড়ে পড়ে আছে নদীর পাড়ে। গাববাগানজুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রচুর ইট। এখানে একসময় প্রাচীন স্থাপনা ছিল। এখন সেগুলো ধ্বংস হয়ে রয়েছে শুধু ইটের স্তূপ। একসময় গাবগাছের বাগানজুড়ে যে মোটা ইটের দেয়াল ছিল, সেটির প্রমাণ এখনো রয়েছে। নদীভাঙনে ওই প্রাচীন স্থাপনা ও গাববাগানের কিছু অংশ বিলীন হয়ে গেছে। আশপাশের ইটগুলো জোয়ারের পানিতে প্রতিনিয়ত ভেসে যাচ্ছে। গাবগাছের বাগানের আশপাশে দেখা গেল বাঘের আনাগোনার চিহ্ন হিসেবে টাটকা পায়ের ছাপ।
ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে গাবগাছের বাগান দেখাটা বিস্ময়ের। তবে আগে এখানে আরও অনেক বেশি গাবগাছ ছিল। সুন্দরবনে আসা জেলেদের অনেকেই এই গাছ থেকে গাব নিয়ে মাছ ধরার জালে ব্যবহার করে। এই এলাকা সুন্দরবনের অন্যান্য এলাকা থেকে অনেক উঁচু। এ কারণে এখনো গাবগাছগুলো বেঁচে আছে। এই গাবগাছের বাগান এখনো বাঘের বিচরণস্থল হিসেবে বেশ পরিচিত।
সুন্দরবনের কালাবগী ফরেস্ট স্টেশন হয়ে শিবসা নদী দিয়ে প্রায় ২২ কিলোমিটার নিচে নদীর পূর্ব পাড়ে প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসস্তূপ ঘিরে গাবগাছের বাগানের অবস্থান। এর একটু দূরে বাঁয়ে মোড় নিয়ে ঢুকে পড়া যায় সুন্দরবনের শেখের খাল ও কালীর খালে। এই দুই খালের মধ্যবর্তী স্থানটি শেখেরটেক নামে পরিচিত। বাংলার মধ্যযুগীয় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি মন্দির। বহু বছর ধরে মন্দিরটি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও, এবার তা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করেছে বন বিভাগ। মোগল আমলে নির্মিত ওই মন্দির ঘিরে তৈরি করা হয়েছে শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। এটি সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের ১৬ নম্বর কম্পার্টমেন্ট এলাকার আওতাভুক্ত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিষয়ের অধ্যাপক এম এ আজিজের লেখা সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ইতিহাস বইয়েও সুন্দরবনের মধ্যে ওই স্থাপনাগুলোর কথা উল্লেখ রয়েছে। তিনি লিখেছেন, সম্ভবত ১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরবন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন বার ভূঁইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্য। সুন্দরবনের বনদস্যু মগ-ফিরিঙ্গি দমনে সুন্দরবনের শিবসা নদীর পাড়ে প্রতাপাদিত্য একটি দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন। শিবসা নদীসংলগ্ন শেখের বাড়ি ও কালীর খালের দক্ষিণে মন্দির এলাকা এই দুর্গের অধীন ছিল। তবে অনেকের মতে, শেখের বাড়ি ও মন্দির ঘিরে যেসব ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে দেখা যায়, সেগুলো রাজা প্রতাপাদিত্যের বহু আগেই স্থাপিত হয়েছিল।
শিবসা নদীর পাড়ে সুন্দরবনের ওই প্রাচীন স্থাপনা ও গাবগাছের বাগান এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে, এমন কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গাববাগানের ওই স্থান অনেকটা উঁচু হওয়ায় জোয়ারের পানিতে ডোবে না। ফলে জোয়ারের সময় সেখানে বাঘের আনাগোনা বাড়ে। উঁচু ইটের স্তূপের ওপর বাঘ বিশ্রাম নেয়। মাঝেমধ্যে বাচ্চাসহ বাঘকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন অনেক জেলে।
সুন্দরবনের মধ্যের এই ভঙ্গুর স্থাপনাগুলো ৩০০-৩৫০ বছর আগে নির্মিত বলে এর স্থাপত্যিক কাঠামো ও শিল্পশৈলী দেখে অনুমান করা যায়। এমন কথা বললেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশালের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন। তাঁর মতে, প্রাচীনকালেও সুন্দরবনে যে মানুষের বসতি ছিল, এটি তার প্রমাণ বহন করে।