নতুন সামুদ্রিক পাখির দেখা
নতুন এক সামুদ্রিক পাখির দেখা মিলেছে বাংলাদেশে। এটি আমার কাছে দারুণ এক খবর। তবে আফসোস, পাখিটি দেখার সঙ্গী আমি হতে পারিনি। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে বিখ্যাত ব্রিটিশ পাখিবিজ্ঞানী গ্যারি অলপর্ট বলেন, কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় যাবেন পাখি দেখতে। বিদেশে থাকায় তাঁর সঙ্গে পাখি দেখতে যেতে পারিনি।
সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখ গ্যারি ও তাঁর আরেক পাখিদেখিয়ে বন্ধু জেন-এরিক নিলসেন কক্সবাজারের ফিশারিঘাট থেকে সোনাদিয়া দ্বীপে যাচ্ছিলেন। বাঁকখালী নদীপথে যাওয়ার পথটা সব সময়ই উপভোগের। এই নদীপথে হরেক রকমের পাখির দেখা মেলে সব সময়ই। মাছ ধরার একটি ট্রলারের পেছনে তাঁরা অনেকগুলো গাঙচিল আর পানচিলের সঙ্গে একটি নতুন পাখির দেখা পেলেন। প্রথমে তাঁদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না। পাখিটির নাম ‘লেসার নডি’। বাংলায় এর নাম হতে পারে ‘ছোট নডি’। পাখিটিকে এ দেশে আগে আর কখনো দেখা যায়নি। সোনাদিয়া থেকে ফেরার পথেও তাঁরা ওই পাখি আরেকবার পেয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় খবর হলো, কক্সবাজার বিমানবন্দরের পাশে একটি ডোবায় আরও তিনটি পাখির দেখা মিলেছে। সব মিলিয়ে এক দিনে চারটি লেসার নডির দেখা মেলে। এর ফলে এ দেশের পাখির তালিকায় আরও একটি নাম যোগ হলো। পাখি–গবেষকদের কাছে সত্যিই এটি একটি বড় খবর।
লেসার নডি পাখিটি কীভাবে এ দেশে এল, তা এক আশ্চর্যের বিষয়। পরিযায়ী পাখির পরিযায়নের মৌসুম সবে শুরু হয়েছে। এ সময় পাখিরা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যায় খাবার আর আশ্রয়ের খোঁজে। লেসার নডি আমাদের দেশের জন্য পরিযায়ী পাখি নয়, এটি চলার পথের পাখি অথবা ইতস্তত ভ্রমণকারী পাখি। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ভ্যাগরেন্ট বার্ড’। এ পাখি একবারই আচমকা এ ধরনের ভ্রমণ করে। চলার পথে এ ধরনের পাখি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিশ্রাম নেয়।
লেসার নডি একটি লরিডি পরিবারের পাখি। এই পরিবারে পৃথিবীতে নডি ছাড়াও গাঙচিল, পানচিল, গাঙচষার শতাধিক প্রজাতি দেখা যায়। বাংলাদেশেও এই পরিবারের প্রায় ২১ জাতের পাখি আছে, যার প্রায় সব কটিই সমুদ্র ও উপকূলের। শুধু এ দেশে নডি গোত্রের কোনো সদস্য ছিল না। এবার লেসার নডির দেখা মেলায় তার পূর্ণতা এল।
পৃথিবীতে নডি গোত্রে পাঁচটি প্রজাতি আছে। এর মধ্যে লেসার নডির অবস্থা বেশ ভালো। বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনালের তথ্য থেকে দেখা যায়, ১৯৮৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পাখিটির সংখ্যা খুব বেশি পরিবর্তিত হয়নি। এই প্রজাতির পাখি ভারত মহাসাগরে বসবাস করে এবং প্রজননের জন্য এরা সেশেলস বা মালদ্বীপ অঞ্চলে যায়। এ ছাড়া সোমালিয়ার কয়েকটি দ্বীপেও এরা প্রজনন করতে যায় বলে ধারণা করা হয়। তবে প্রজননকালের বাইরে এ পাখি আরব, মাদাগাস্কার ও তানজানিয়ার উপকূলে দেখা যায়। শ্রীলঙ্কা আর বঙ্গোপসাগরে এদের চলাচল একেবারেই বিরল।
লেসার নডি প্রজাতির পাখি দলেই বেশি থাকতে পছন্দ করে। প্রজননকালের বাইরে ছোট ছোট দলে থাকে। তবে ডিম পাড়ার মৌসুমে কয়েক হাজার এই পাখি একসঙ্গে বাসা বানায়। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তাদের ঘরসংসারের কাজ সম্পন্ন হয়। এরপর এ পাখি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পরিযায়ন করে; কিন্তু ঠিক এ সময় সোনাদিয়ায় পাখিটি দেখা সত্যিই বিরল ঘটনা। গোটা পৃথিবীতে এই জাতের লক্ষাধিক পাখি টিকে আছে বলে ধারণা করা হয়।
অদূর ভবিষ৵তে আবাসস্থলসংকট এই প্রজাতির পাখির জন্য বড় সমস্যা। ইঁদুরজাতীয় প্রাণী এ পাখির ডিম খেয়ে ফেলে। আস্ট্রেলিয়ায় মানুষ এই পাখি ও এর ডিম শিকার করে খায়। এত কিছুর পরও পাখিটি প্রকৃতিতে বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে। আশা করি, পাখিটি আমাদের দেশ থেকে তার আবাসভূমিতে ভালোভাবে ফিরে যাবে। আসছে পরিযায়ন মৌসুমে সোনাদিয়ায় যাব পাখি গণনায়। পাখিটির দেখা পেলে নিশ্চয়ই সৌভাগ্যবানদের একজন হব। পাখিবন্ধু গ্যারি ও এরিককে ধন্যবাদ। তাঁরা এ দেশের পাখি গবেষণায় অবদান রাখতে পারছেন।
সীমান্ত দীপু: বন্য প্রাণী-গবেষক