রাসেলস ভাইপার-আতঙ্ক: চন্দ্রবোড়ার সত্য–মিথ্যা 

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ে আহত জাহিদুল ইসলামফাইল ছবি

সাপের ছবি আর তার ভয়ংকর রকম ব্যাখ্যা এখন ফেসবুকের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে পড়ছে। একজন লিখেছেন, সাপের ভয়ে ফেসবুক খুলতে পারছেন না। একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক লিখেছেন, ‘অনেক হয়েছে, এবার সাপের পোস্ট দেওয়া বন্ধ করুন, আর নিতে পারছি না।’

ভয় দেখাতে, ভিড় সরাতে আবার মজমা জমাতে সাপের জুড়ি নেই। স্বৈরশাসক আইয়ুব-মোনায়েমের পোষা গুন্ডা ছাত্রনেতা পাঁচ পাত্তু (পাস পার্ট টু) একটা সাপ নিয়ে চলতেন। তখনকার ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে দেখলেই পথ ছেড়ে দিতেন সমীহ করে নয়, সাপের ভয়ে। এখন ‘লবঙ্গ’ সাইজের পিস্তল পাওয়া যায়। তাই সাপের আর দরকার হয় না। তবে প্রতিপক্ষের মিছিলে, জনসভায় সাপের প্রয়োজন এখনো একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। খোলা সাপে যেমন ভয়, বাঁধা সাপে আবার তেমন আকর্ষণ। 

সাপুড়ে তাঁর ঝাঁপি নিয়ে বসলে লোক ডাকতে হয় না, বয়সী-অবয়সী সবাই বেশ শৃঙ্খলার সঙ্গে বসে বা দাঁড়িয়ে যায়। ষাটের দশকে ঢাকায় কাছারির (ডিসি অফিস) মাঠে ‘শিলাজিৎ হালুয়া’ বিক্রেতার সঙ্গে সাপুড়েদের প্রায় গোল বাধত ভিড় ভাঙানো নিয়ে। সাপুড়েরা ঝাঁপি খুলে বসে গেলে মাগনা হালুয়া খাইয়েও তাঁরা আর দর্শক ধরে রাখতে পারতেন না। জনতা ছুটত সাপের কাছে। হালুয়ার চেয়ে ভয়ংকর সাপের প্রতি কেন এত আকর্ষণ! কে জানে? নিষিদ্ধ ফলের প্রতি আকর্ষণের গল্প আমরা জানি। তার ফলও আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। কিন্তু খাসলতের কোনো রকমফের হয়নি। তাই বুঝি এড়িয়ে চলার সাপ আমাদের এত আকর্ষণ করে। 

একসময় সিনেমায়ও দর্শক টানতে সাপ চলে আসত কাহিনিতে। এখন ফেসবুকেও লাইক পাওয়ার একটা সহজ তরিকা হচ্ছে সাপের পক্ষে, বিপক্ষে ছবি। মিথকে রিয়েল বলে চালিয়ে দেওয়ার ঝোঁক এমনভাবে ডালপালা মেলতে থাকে যে দিনের শেষে কমবেশি সবাই সাপুড়ে ওঝা সর্বসর্পবিশেষজ্ঞ হওয়ার ঝুঁকিতে চলে যান। বোধ করি সেই ধারাবাহিকতায় এখন চলছে কথিত রাসেলস ভাইপার আলোচনা। 

ষাটের দশকে ঢাকায় কাছারির (ডিসি অফিস) মাঠে ‘শিলাজিৎ হালুয়া’ বিক্রেতার সঙ্গে সাপুড়েদের প্রায় গোল বাধত ভিড় ভাঙানো নিয়ে। সাপুড়েরা ঝাঁপি খুলে বসে গেলে মাগনা হালুয়া খাইয়েও তাঁরা আর দর্শক ধরে রাখতে পারতেন না।

চন্দ্রবোড়ার নাম রাসেলস ভাইপার কেন? 

চন্দ্রবোড়ার ইংরেজি নাম রাসেলস ভাইপার। আজকাল অনেকেই রাসেল ভাইপার বলছে। এটা ভুল নাম। স্যার প্যাট্রিক রাসেল আমাদের এই উপমহাদেশের সাপের শ্রেণিবিন্যাসের বা ক্যাটালগিংয়ের কাজ শুরু করেন সতেরো শতকের শেষের দিকে। বলা হয়, তিনি প্রথম কাগজে–কলমে এ অঞ্চলের অনেক সাপের পরিচিতি এবং বিশ্লেষণ করেছিলেন। তার মধ্যে রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়াও ছিল। তাই আঠারো শতকে সাপের চূড়ান্ত শ্রেণিবিন্যাসের সময় রাসেল সাহেবের সতীর্থ বিজ্ঞানীরা তাঁর নাম জুড়ে দেয় এই সাপটির সঙ্গে। সেই থেকে চন্দ্রবোড়া হয়ে যায় রাসেলস ভাইপার। 

চন্দ্রবোড়া কতটা বিষধর

বলা হচ্ছে, এটা পৃথিবীর পঞ্চম বিষধর সাপ। কথাটা সঠিক নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে এটা মারাত্মক প্রথম ৩০ সাপের মধ্যেও নেই। বরং এটির অবস্থান আমাদের দেশের গোখরা সাপের পরে। গোখরা সাপ কামড়ালে চিকিৎসা না নিলে গড়ে ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের ক্ষেত্রে গড়ে ১৮ ঘণ্টা পর ও চন্দ্রবোড়ার কামড়ের পর গড়ে ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পরে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোগীর অন্য কোনো অসুস্থতা না থাকলে ৭২ ঘণ্টার আগে রোগী সহজে মারা যায় না। বাংলাদেশে এই সাপের কামড়ের পর ১৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার রেকর্ড আছে। 

এখানে সাম্প্রতিক কালের দুটি ঘটনা বর্ণনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। 

গত বছর ৩ জুলাই সোমবার সকালে পদ্মার চরে (রাজবাড়ী জেলার পাংশা সুর চরপাড় এলাকা) পাটখেতে নিড়ানি দিতে গিয়ে জাহিদুল (৩৫) সাপের কবলে পড়েন। তাঁকে চন্দ্রবোড়া কামড় দিলে সাপটিকে মেরে মরা সাপসহ তাকে অন্য কোথাও না নিয়ে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাঁর স্বজনেরা। কুষ্টিয়ার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে যান। 

আঠারো শতকে সাপের চূড়ান্ত শ্রেণিবিন্যাসের সময় রাসেল সাহেবের সতীর্থ বিজ্ঞানীরা তাঁর নাম জুড়ে দেয় এই সাপটির সঙ্গে। সেই থেকে চন্দ্রবোড়া হয়ে যায় রাসেলস ভাইপার। 

অন্য ঘটনায় গত ৫ মার্চ মঙ্গলবার সকালে পদ্মায় মাছ ধরতে গিয়ে চন্দ্রবোড়ার ছোবলের শিকার হন তারিকুল ইসলাম (বাড়ি কল্যাণপুর, শিলাইদহ ইউনিয়ন, উপজেলা কুমারখালী)। তরিকুলের ডান পায়ে সাপ কামড় দিলে তিনি তাঁর সাথিদের বিষয়টি জানাতে একটু সময় নেন। বন্ধুরা আক্রান্ত স্থানে রশি দিয়ে বেঁধে দেন। তাঁদের ধারণা ছিল, এতেই কাজ হবে। অবস্থা বেগতিক দেখে স্থানীয় লোকজন তাঁকে তাঁর বাড়ি নিয়ে যান। এরপর পরিবারের লোকজন তাঁকে কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে অর্থাৎ প্রায় সাত–আট ঘণ্টা সময় পার হয়ে গেছে। পরদিন বুধবার তাঁকে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ মার্চ বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর মৃত্যু হয়। 

আরও পড়ুন

একই জাতের সাপের কামড়ের রোগী একই হাসপাতাল, দুটি ক্ষেত্রেই চিকিৎসক আর তাঁর সহকারীদের মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না। তারপরও একজন সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরলেন, আরেকজনকে বাঁচানো গেল না। স্রেফ সময় এখানে প্রধান বিষয় হিসেবে কাজ করেছে। প্রথমজন সাপে কাটার ১৯০ মিনিট অর্থাৎ ৩ ঘণ্টা ১০ মিনিটের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে পেরেছেন। পরেরজন হাসপাতাল থেকে তুলনামূলকভাবে কম দূরত্বে থেকেও সময়মতো পৌঁছাতে পারেননি। সাপে কামড়ানোর চিকিৎসায় প্রথম ১০০ মিনিট খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ের মধ্যে ১০টি অ্যান্টিভেনম নিতে হয়। সেটাই চ্যালেঞ্জ। একজন তরুণ চিকিৎসক তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি নিজে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ইন্টার্ন করার সময়ে কম করে হলেও চারজন চন্দ্রবোড়া কামড়ের রোগীকে সুস্থ করেছি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (২০০৮-০৯) এবং দেশের প্রখ্যাত সর্প দংশন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ মনে করেন, চন্দ্রবোড়া নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা দিতে পারলে বিষক্রিয়া থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, অধ্যাপক ফয়েজ ১৯৭৮ সাল থেকে সর্প দংশনের ওপর গবেষণা করে আসছেন। তাঁর মতে, মানুষ ওঝার কাছে গিয়ে অহেতুক সময় নষ্ট করার কারণে মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। 

চন্দ্রবোড়া কেন বেশি কামড়াচ্ছে? 

মানুষ যেমন সাপকে ভয় পায়, সাপও তেমন মানুষকে এড়িয়ে চলে। প্রায় সব সাপই মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই সরে যায়। কিন্তু চন্দ্রবোড়া খুবই অলস প্রকৃতির সাপ। অনেক সময় সে গতর খাটিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় না গিয়ে কচুরিপানার সাহায্য নেয়। পানার মধ্যেই শুয়ে থাকে। সে এতটাই অলস যে মানুষ দেখে তেড়ে আসা অথবা পালানো, কোনোটিই তার স্বভাবে নেই। এমনকি বাধ্য না হলে নিজের জায়গা থেকে নড়েই না, একই জায়গাই তিন-চার দিনও পড়ে থাকে। সেই কারণেই এদের কামড়ের অধিকাংশ রেকর্ডই হলো হয় মানুষ তাকে আঘাত করেছে, অথবা হাত দিয়েছে কিংবা অজগর ভেবে ধরতে গেছে। কামড় দেওয়ার পরও সে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে না। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি তাকে দেখতে পায়। কামড় দেওয়ার পর সাপটা দেখা যায় বলে রোগী বা অন্যরা নিশ্চিত হতে পারে। ফলে একজন চিকিৎসক দ্রুত সঠিক অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে পারেন। তাই ঝুঁকিও কমে যায়। এ কারণেও এটি অন্য বিষধর সাপের চেয়ে কম আতঙ্কের। 

আরও পড়ুন

করণীয়

অধ্যাপক এম এ ফয়েজের মতো বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে একটা টাস্কফোর্স তৈরি করে চন্দ্রবোড়ার চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ এবং জনসচেতনতা তৈরি করা দরকার। মানুষ ভীত হয়ে নির্বিচার সাপ মারছে, এটা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। কোথাও কোথাও জনপ্রতিনিধিরা সাপ মারার জন্য নগদ অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। এটাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সাপ শুধু ইঁদুর খেয়ে আমাদের উপকার করে না, তার বিষও অনেক ওষুধের কাঁচামাল। হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী, এমনকি ব্যথানাশক নানা ওষুধ তৈরিতে সাপের বিষ ব্যবহার করা হয়। 

সাপের বংশবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাকৃতিক ব্যবস্থার ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। চিল, প্যাঁচা, শিয়াল, বনবিড়াল, বানর, গুইসাপ, বেজি ইত্যাদিসহ আরও বেশ কিছু প্রাণী রক্ষার জন্য প্রচারণা চালাতে হবে। 

# লেখক ও গবেষক: [email protected]