প্রায় পাঁচ বছর আগের ঘটনা। কক্সবাজারের সোনাদিয়ার কালাদিয়া চরে গেলাম মহাবিপন্ন চামচঠোঁটি চা-পাখিসহ কিছু বিরল ও বিপন্ন পরিযায়ী পাখির সন্ধানে। ওগুলোর ছবি তুলে বিকেলে ফিরতি পথ ধরলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর বড় গুলিন্দার একটি বড় ঝাঁকের সঙ্গে দেখা হওয়ায় ওখানে দু-তিন মিনিট সময় দিয়ে সামনের দিকে এগোলাম।
খানিক পরেই খড়ির চরের সামনে চলে এলাম। আমাদের গাইড গিয়াস চরে নেমে আশপাশে পাখির খোঁজ নিতে গেল। আর আমরা বদরকৈতরের ঝাঁক দেখে একটু সামনের দিকে এগোলাম। পানিতে জেগে থাকা একচিলতে বালুচরে প্রায় হাজারখানেক বদরকৈতর-গাঙচিল বসে আছে। স্পিডবোট ওগুলোর কাছাকাছি যেতেই প্রথমে উড়ল খোঁপাযুক্ত বড় গাঙচিলের একটি দল। এরপর অল্পকিছু বড় বদরকৈতর এবং সবশেষে উড়ল বদরকৈতরের ঝাঁক। স্পিডবোট থেকে পাঁচটি ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক ধ্বনি বেড়েই চলেছে। ছবি তোলা শেষ হলে গিয়াসকে নেওয়ার জন্য আবার খড়ির চরের দিকে গেলাম।
হোটেলে ফিরে ছবিগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করতেই বদরকৈতরের ঝাঁকে সরুচঞ্চু ও সাদাটে চোখের অন্য রকম একটি পাখি দেখলাম। নতুন ও বিরল একটি পাখির ছবি তুলেছি মনে করে বেশ আনন্দিত হলেও বাসায় ফিরে ভালোভাবে পরীক্ষা করে মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
এরপর এই পাঁচ বছরে যতবার সোনাদিয়ায় গেছি, ততবারই পাখিটির সন্ধান করেছি; কিন্তু কোনো হদিস পাইনি। অবশেষে কদিন আগে বাংলাদেশে অবস্থানকারী দুজন বিদেশি পক্ষীবিদের ফেসবুক পোস্টে পাখিগুলোর সোনাদিয়ার আসার সংবাদ পেয়ে ‘বার্ডিংবিডি ট্যুরস’-এর তত্ত্বাবধানে গত ২২ নভেম্বর সকালে কক্সবাজারে পৌঁছালাম। গুদারাঘাট থেকে রওনা দেওয়ার ২০ মিনিটের মাথায় জায়গামতো অর্থাৎ বিমানবন্দরের পেছনের দিকে বাঁকখালী নদীর মোহনায় পৌঁছে গেলাম। সেখানে কিছু জেলেনৌকার সামনে একঝাঁক বদরকৈতর উড়তে দেখে দ্রুত গেলাম। আর সঙ্গে সঙ্গেই পাঁচ বছর আগের অদেখা পাখিটির সন্ধান পেয়ে গেল। যদিও জেনেছিলাম, তিনটি পাখি এসেছে; কিন্তু আমি সেখানে চারটি পাখি পেলাম। ৪০ থেকে ৫০ মিনিট ওগুলোর সঙ্গে থেকে বেলেকেরদিয়ার পথে স্পিডবোট ছোটালাম। ফিরতিপথে পড়ন্ত বিকেলের সোনালি আলোয় আবার ওই পাখিগুলোর সঙ্গে দেখা হলো। তবে এবার সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে হলো।
এতক্ষণ সরুচঞ্চু ও সাদাটে চোখের অন্য রকম যে পাখির গল্প করলাম, সেটি এ দেশে বিরল ও তথ্য অপ্রতুল পরিযায়ী পাখি স্লেন্ডার-বিল্ড গাল (Slender-billed Gull)। এর কোনো বাংলা নাম নেই। ইংরেজি নামের অনুবাদ করলে দাঁড়ায় সরুচঞ্চু গঙ্গাকৈতর বা সরুঠোঁটি গঙ্গাকৈতর। ল্যারিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Larus genei। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা, মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও কাজাখস্তানের আবাসিক পাখিটি শীতে বাংলাদেশসহ ভারত ও কখনো কখনো ইউরোপে পরিযায়ন করে।
প্রাপ্তবয়স্ক সরুচঞ্চু গঙ্গাকৈতরের দেহের দৈর্ঘ্য ৪২ থেকে ৪৪ সেন্টিমিটার। ওজন ২২০ থেকে ৩৫০ গ্রাম। মাথা, গলা, কোমর ও লেজ সাদা। পিঠ ও ডানার ওপরের অংশ ধূসর। ডানার বাইরের প্রান্ত সাদা ও প্রাথমিক পালকের আগা কালো। দেহের নিচটা সাদা, অনেক সময় তাতে গোলাপি আভা থাকে। চোখের রং হলদে সাদা, রয়েছে লাল অক্ষিবলয়। সরু ও লম্বাটে চঞ্চুর রং গাঢ় লাল। লম্বা পা কালচে-লাল। স্ত্রী–পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথায় ধূসর দাগ ও ডানায় গাঢ় ছোপ চোখে পড়ে। পা গোলাপি-কমলা।
এ দেশে এই পাখিকে মূলত সমুদ্র উপকূল ও বড় নদীতে কদাচ দেখা যায়। সচরাচর একাকী বা অন্য গঙ্গাকৈতর ও বদরকৈতরের মিশ্র ঝাঁকে বিচরণ করে। অল্প পনিতে মাথা ডুবিয়ে বা কাদায় চঞ্চু ঢুকিয়ে মাছ, সামুদ্রিক অমেরুদণ্ড প্রাণী, চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি খায়। অনেক সময় উড়ন্ত কীটপতঙ্গও খেতে পারে। খাবারের জন্য জেলে নৌকার পিছু নিতেও ছাড়ে না। নাকি সুরে ‘ইয়েপ-ইয়েপ...’ শব্দে ডাকে।
মার্চ থেকে জুন প্রজননকাল। এ সময় সরুচঞ্চু গঙ্গাকৈতর মূল আবাস এলাকার হ্রদ ও উপহ্রদের পাশে উন্মুক্ত মাটিতে সামান্য খোদল করে বাসা বানায়; অনেক সময় পালক, উদ্ভিদ ইত্যাদি দিয়ে বাসার গদি বানায়। কখনো কখনো তৃণভূমিতেও বাসা বানাতে পারে। বিপুলসংখ্যক পাখি (প্রায় এক হাজার জোড়া) একসঙ্গে গাদাগাদি করে কলোনি বাসা গড়ে। ডিম পাড়ে দুই থেকে তিনটি, রং বাদামি ছিটসহ ঘিয়ে সাদা। ডিম ফোটে প্রায় ২২ দিনে। ছানাগুলো ৩০ থেকে ৩৭ দিনে উড়তে শেখে। তবে প্রজননক্ষম হতে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগে। আয়ুষ্কাল ১০ থেকে ১১ বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন এবং চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ