অবৈধ পাখি–বাণিজ্যের ফাঁদ
২০২০ সালে একদিন কিছু নথি ই–মেইলে এসে পৌঁছাল। বাংলাদেশ কাস্টমসে কর্মরত পাখি পর্যবেক্ষক এক বন্ধুর পাঠানো নথিগুলো দেখে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকা শত শত বিদেশি পাখির চালানপত্র সেসব নথিতে।
বলিভিয়ার ম্যাকাও, দক্ষিণ আফ্রিকার সারস, নিউজিল্যান্ডের কাকাতুয়া, আর্জেন্টিনার ট্যুকান, অস্ট্রেলিয়ার এমু—কী নেই সেখানে! সে এক দীর্ঘ তালিকা। কৌতূহলী হয়ে আমরা দুই বন্ধু এই পাখিদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন কী বলে, তার খোঁজ করি। দেখা যায়, অধিকাংশ পাখি কেনাবেচা আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ। সেই থেকে বনের পাখির খোঁজের পাশাপাশি এসব বিদেশি পাখির বিষয়েও খবর রাখা শুরু করি।
গত তিন-চার বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশি-বিদেশি পাখি কেনাবেচার অস্বাভাবিক বিস্তার যে কারও চোখে পড়ার মতো। একসময় দেখি, একেবারে বুনো পরিবেশ থেকে ধরে আনা পাখিও বাংলাদেশের পোষা পাখির বাজারে ঢুকছে। বাংলাদেশে বন বিভাগের ২০২২ সালের অভিযানে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়া ২৭টি হুতোম প্যাঁচা আর ইগল সে রকমই একটি উদাহরণ, ধরেছিল মালি থেকে। জুলাই মাসে যখন সাইটিস এই অনিয়ন্ত্রিত পোষা পাখি বাণিজ্য রোধে বাংলাদেশের সদস্যপদ স্থগিত করল, অবাক হইনি। এটিই ভবিতব্য ছিল।
সাইটিস (Convention on International Trade in Endangered Species of Wild Fauna and Flora) হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে, যাতে করে বুনো পরিবেশে ওদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে না পড়ে। বাংলাদেশ এই চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সদস্য। সাইটিসে বন্য প্রজাতিগুলোকে তিন ধরনের তালিকায় ভাগ করা হয়েছে।
পরিশিষ্ট একভুক্ত প্রজাতিগুলো বৈশ্বিকভাবে বিলুপ্তির মুখে আছে, এদের ক্রয়-বিক্রয় কেবল সাইটিস অনুমোদন করে। পরিশিষ্ট দুই ভুক্ত প্রজাতিগুলোর বাণিজ্যও নিয়ন্ত্রিত। তা না হলে তারা বুনো পরিবেশ থেকে দ্রুতই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পরিশিষ্ট তিনে থাকা প্রজাতিগুলোকে টিকিয়ে রাখতে এদের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
সাইটিস প্রথমে ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশকে এ বিষয়ে সতর্ক করে চিঠি দেয়। ‘পোষা পাখি পালনের নীতিমালা ২০২০’ আধুনিকায়নসহ চারটি প্রধান বিষয়ে সুপারিশ করে। এর মধ্যে আরও ছিল পোষা প্রাণী বাণিজ্যে নজরদারি ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল তথ্যভান্ডার তৈরি করা। এ বাজার নিয়ে গবেষণা ও সমীক্ষা করার আর্জি ছিল। অথচ এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত মাত্র দুটি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
সেই একই বছর আমার আরেক পাখি গবেষক বন্ধু মোহাম্মদপুরের এক পোষা পাখির মেলা থেকে কিছু ছবি পাঠান। রীতিমতো উৎসব করে নানা ধরনের অদ্ভুতদর্শন পাখি প্রদর্শিত হচ্ছে। ছবিতে প্রথমেই দেখতে পেলাম এক জোড়া লম্বাঠুঁটি ট্যুকান, তারপর নীল-সোনালি ম্যাকাও—এরা সাইটিস পরিশিষ্ট এক ও দুইভুক্ত পাখি।
একই বছর অত্যন্ত হৃদয়বিদারক একটি অভিযানে বাংলাদেশ বন বিভাগ তিনটি লিয়ারের ম্যাকাও হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উদ্ধার করে, টিয়া পাখির এই বড় জাত ভাইয়েরা শুধু আমাজনে থাকে আর কয়েক শই মাত্র টিকে আছে। ছোট কাঠের বাক্সে ঠাসাঠাসি করে আরও নানা পাখির মধ্যে মিশিয়ে এদের আনা হচ্ছিল।
২০২৩–এর এক গভীর রাতে বাংলাদেশ বন বিভাগের এক বন্ধু যোগাযোগ করলেন। বন্ধুটি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক অভিযানে ছিলেন। একটি চালানে বাণিজ্য নিষিদ্ধ সবুজ-পাখা ম্যাকাও আছে, এমনটা ছিল তাঁর সন্দেহ। ছবি দেখে আমিও একমত হলাম। কিন্তু আমদানিকারকের কাগজপত্র বলছে, সেগুলো খামারে উৎপাদিত ম্যাকাও। বন্ধুটির মতামত, ছোট বাক্সে এসব চালান থেকে নিষিদ্ধ পাখি চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য। এসব চালান আসে প্রায় মাঝরাতে আর খুব দ্রুতই খালাস করা হয়। আমার কাস্টমসের বন্ধুটিও একই মতামত দেন। তাঁদের ধারণা অমূলক নয়। সাইটিস তথ্যভান্ডার বলছে, ২০২০ থেকে ২০২৩–এর মধ্যে হাজারটির বেশি সবুজ-পাখা ম্যাকাও বাংলাদেশে ঢুকেছে। এসবের ফলাফল এই আন্তর্জাতিক স্থগিতাদেশ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পোষা পাখিপালকদের বাধ্যতামূলক লাইসেন্স গ্রহণ, পোষা পাখিদের চিহ্নিতকরণ রিং পরানো, ব্যক্তিমালিকানাধীন পোষা পাখির সর্বোচ্চ সংখ্যা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাঁটাবন পোষা প্রাণীর বাজারে অবৈধ কার্যক্রম রোধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিছু পাখি খামারের লাইসেন্স বাতিল করেছে। তবে আরও কিছু করার আছে।
বাংলাদেশে পোষা প্রাণীর বাজার ক্রমেই বাড়ছে, এটি বিবেচনা করতে হবে। পাখির পাশাপাশি সাপ, ব্যাঙ, বিচ্ছু, মাকড়সা, কোরাল নানা কিছু বাংলাদেশে ঢোকে। ফেসবুক-ইউটিউবে সেসবের বিক্রি-প্রদর্শনী হামেশাই হয়। দেশের বন্য প্রাণীও বাইরে যাচ্ছে। গত তিন বছরে অন্তত ছয়টি কালো ভালুকের বাচ্চা পাচারকালে উদ্ধার হয়েছে। কয়েকটি ছিল একেবারে দুধের বাচ্চা। আবার কিছু ধরা পড়েছে সীমানা পেরিয়ে ভারতীয় কাস্টমসে।
মানুষকে বোঝাতে হবে। অবৈধ পোষা প্রাণী সহজে চেনার ব্যবস্থা নিতে হবে। সামগ্রিক উদ্যোগই কেবল এই সমস্যার সমাধান করতে পারে।
মুনতাসীর আকাশ: সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়