দুর্লভ দুই ডুমুরের কথা

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে হস্তীকর্ণ ডুমুরগাছছবি: লেখক

পুষ্প, বৃক্ষ, লতা, গুল্মে সমৃদ্ধ ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন। গত ২৬ অক্টোবর গিয়েছিলাম ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত এই উদ্যানে। সেখানে ডুমুরের বেশ কয়েকটি প্রজাতি আছে। সেগুলোর মধ্য থেকে দুই ধরনের ডুমুরের পরিচিতি এ লেখায় তুলে ধরছি।

হস্তীকর্ণ ডুমুর

বড় হৃৎপিণ্ড আকৃতির পাতাবিশিষ্ট এই গাছের গোড়া থেকে ওপরের দিকে ফল চোখে পড়ল। পাতা দেখতে হাতির কানের মতো, তাই এই প্রজাতির নাম হস্তীকর্ণ ডুমুর। বৈজ্ঞানিক নাম Ficus auriculata, এটি Moraceae পরিবারের ছোট বৃক্ষ। ইংরেজিতে এটি Roxburgh fig, Elephant ear fig, Giant indian fig নামে পরিচিত। এই উদ্ভিদের আদি নিবাস এশিয়ার উপক্রান্তীয় ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল।

উদ্ভিদটি ৫-১০ মিটার উঁচু হয়। পাতাগুলো বড় ও গোলাকার; ৪৪ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৪৫ সেন্টিমিটার চওড়া। পাতা গোলাকার বা হৃদয় আকৃতির। পাতার নিচের পিঠে লোম থাকে। কচি পাতা গোলাপি-বাদামি। পাতায় গোড়া থেকে ৫-৭টি প্রধান শিরা থাকে। এর পাতার বোঁটা ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এই উদ্ভিদ ভিন্নবাসী, অর্থাৎ এর পুরুষ ও স্ত্রী ফুল পৃথক পৃথক উদ্ভিদে উৎপন্ন হয়। ফল পাকলে হালকা হলুদ থেকে বেগুনি হয়ে যায়। ফল একটি মাংসল আধার। ফলগুলো কাণ্ডে, শাখায় ও শিকড়েও গুচ্ছাকারে হয়।

এই ডুমুরগাছের শাখা-প্রশাখা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে ওপরে মুকুট তৈরি করে। আঘাতপ্রাপ্ত কাণ্ড থেকে ক্রিম রঙের ল্যাটেক্স বা তরুক্ষীর বের হয়। উদ্ভিদের মাংসল ফলের মতো গঠন সিনকোনিয়াম নামে পরিচিত। এরা সরাসরি মূলীয় শাখা এবং কাণ্ডে গুচ্ছাকারে উৎপন্ন হয়। সিনকোনিয়াম বড় ও ফাঁপা। এটি ভেতরের দেয়ালে অসংখ্য ছোট ফুল বহন করে। বোলতা দ্বারা এর পরাগায়ন হয়। সিনকোনিয়ামগুলো লাল-বাদামি থেকে দাগযুক্ত লাল-বেগুনি পর্যন্ত পাকে। এরা পরিপক্ব হওয়ার পর সুগন্ধি, মিষ্ট ও খাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠে।

ফল ও পাতা খাওয়ার যোগ্য। কচি ডুমুর বেশ স্বাদহীন, তবে কাঁচা ফল দিয়ে ‘মাটন কারি’ রান্না করা যায়। পাকা ডুমুর জ্যাম তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় মালয়েশিয়ায় পাতার নির্যাস খাওয়া হয়। কচি পাতা গবাদিপশুসহ অন্যান্য পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলের নির্যাসে অনেক ফেনোলিক যৌগ থাকে।

পর্তুগিজ উদ্ভিদবিদ জোয়াও দে লরিরো ১৭৯০ সালে প্রথম এই উদ্ভিদের বর্ণনা দেন। উদ্ভিদবিদ উইলিয়াম রক্সবার্গের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘রক্সবার্গ ডুমুর’। উইলিয়াম রক্সবার্গ ১৭৯৩ সালে কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন।

এই প্রজাতির আদি নিবাস উত্তর-পূর্ব পাকিস্তান থেকে দক্ষিণ চীন ও মালয়েশিয়ান উপদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বৃক্ষ আসাম, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, দক্ষিণ চীন, পূর্ব ও পশ্চিম হিমালয়, হাইনান, ভারত, লাওস, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, তিব্বত ও ভিয়েতনামে পাওয়া যায়।

বোটানিক্যাল গার্ডেনে রোমশ ডুমুর
ছবি: মো. আশরাফুজ্জামান

রোমশ ডুমুর

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে পাওয়া কয়েক ধরনের ডুমুরের মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য হলো ‘রোমশ ডুমুর’। এই প্রজাতির ফল ও শাখা-প্রশাখার গায়ে প্রচুর লোম থাকে। এই উদ্ভিদের প্রজাতির নাম Ficus simplicissima, এটি Moraceae পরিবারের বৃক্ষ। এই ডুমুরের আদি নিবাস এশিয়া। এটি পূর্ব ভারতীয় রোমশ ডুমুর নামেও পরিচিত। নেপাল থেকে দক্ষিণ চীন এবং ইন্দো-চীন, সুমাত্রা ও জাভা পর্যন্ত এর স্থানীয় পরিসর।

এই উদ্ভিদ ১৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। উদ্ভিদের পত্রবিন্যাস বিপরীত, পাতা ডিম্বাকৃতির, কিছুটা গোলাকার, ৩-৫টি খণ্ডযুক্ত, রোমহীন। শাখা-প্রশাখা বাদামি রোমযুক্ত, উপপত্র লাল, ডিম্বাকৃতির আকৃতির। শাখাগুলো নলাকার, শুকিয়ে গেলে কুঁজো হয়ে যায়। ফলগুলো সাধারণ শাখায় পাতার অক্ষে জোড়ায় জোড়ায় জন্মায়। ফল সোনালি হলুদ বা বাদামি লোমযুক্ত, গোলাকার, বৃন্তহীন।

  • চয়ন বিকাশ ভদ্র: অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান, মুমিনুন্নিসা সরকারি কলেজ, ময়মনসিংহ