১৬ বছর আগের কথা। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রবন্ধ উপস্থাপনার জন্য পেনাংয়ের ইউনিভার্সিটি সায়েন্স মালয়েশিয়ায় গেলাম। সম্মেলন শেষে দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শন করলাম, পেনাং ওয়ার মিউজিয়াম ও পেনাং বার্ড পার্ক। ওয়ার মিউজিয়াম পেনাং দ্বীপপুঞ্জের ভেতর অবস্থিত হলেও বার্ড পার্কটির অবস্থান মূল ভূখণ্ডে অর্থাৎ বাটারওর্থসে। কাজেই এটি দেখার জন্য ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ পেনাং প্রণালি পাড়ি দিলাম দ্বিতল ফেরিতে।
যেহেতু সম্মেলনে যোগ দিতে বাসে করে প্রায় ১৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পেনাং সেতু পাড়ি দিয়েছি, তাই এবার সেতু দিয়ে আর গেলাম না। ২০ মিনিটে পেনাং প্রণালি পাড়ি দিলেও ফেরিঘাট থেকে পার্কে পৌঁছাতে এক ঘণ্টার বেশি লেগে গেল। গাইডের সাহায্য ছাড়া একা একা যাওয়ায় বেশি সময় লাগল। তবে পার্কে ঢুকেই মনটা ভালো হয়ে গেল।
যদিও বেশির ভাগ পাখিই খাঁচার ভেতর রাখা, কিন্তু ওড়াউড়ি করার জন্য কিছুটা জায়গাও আছে। অনেক প্রজাতির পাখিই নিয়মিত ডিম-ছানা তুলছে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ছবি তুললেও বাংলাদেশে আছে, এমন প্রজাতির প্রতিই আমি বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। ৪ ঘণ্টা ৬ মিনিটে প্রায় ১১৭ প্রজাতির পাখির ছবি তুলে বেলা ২টা ৫৮ মিনিটে সুদর্শন এক ঘুঘু দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কারণ, সেটি ছিল আমাদের দেশের এক বিরল আবাসিক পাখি, যা মালয়েশিয়ার প্রকৃতিতেও দেখা যায়।
দেশে ফেরার পর যখনই সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের বনজঙ্গল, উদ্যান ও অভয়ারণ্যে গিয়েছি, পাখিটিকে খুঁজেছি, বিশেষ করে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। কিন্তু আজ পর্যন্ত দেখা পাইনি। তবে এ দেশের প্রকৃতিতে কোনো না কোনো দিন ওর দেখা পাব বলে বিশ্বাস করি। নয়নকাড়া এই পাখির কোনো প্রচলিত বাংলা নাম নেই। তবে অনুবাদ করে অনেকে ডোরা কুলি-ঘুঘু, ডোরা কোকিল-ঘুঘু বা ডোরা ঘুঘু বলেন। পশ্চিমবঙ্গে বলে ছিট্ ঘুঘু। ইংরেজি নাম বার্ড কুক্কু-ডোব বা লার্জ কুক্কু-ডোব। কোলাম্বিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Macropygia unchall। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, চীন, লাওস, ভিয়েতনাম, ইন্দোচীনসহ এশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে এরা বাস করে।
ডোরা কুলি-ঘুঘু লম্বালেজের সুদর্শন পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের দৈর্ঘ্য ৩৫ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার। ওজন ১৫০ থেকে ১৮০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষের চেহারায় সামান্য পার্থক্য থাকে। মাথা ধাতব বেগুনি-গোলাপি। মাথার চাঁদি, ঘাড়ের পেছন ও বুকের ওপর উজ্জ্বল সবুজ আভা রয়েছে। গলা ও কপাল হলদে। ঘাড়ের পাশ ও বুকের ওপরের অংশে কালচে ডোরা রয়েছে। পায়রার ক্ষেত্রে ডোরাগুলো বেশি মোটা। পিঠ ও ডানা লালচে যার ওপর অতি সূক্ষ্ম²কালচে ডোরা থাকে। কালচে-বাদামি লেজের ডোরাগুলো লালচে-বাদামি। দেহের নিচের দিক পাটল-বেগুনি ও পীতাভ। স্ত্রীর মাথা ও ঘাড়ে সবুজ ও বেগুনি আভা একেবারেই কম। চোখ বেগুনি ও চোখের চারদিকের চামড়া নীলচে-ধূসর। চঞ্চু কালো। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল গোলাপি। নখ বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে মায়ের মতো, তবে অনুজ্জ্বল ও ধাতব দ্যুতিহীন।
ওরা মূলত পাহাড়ি মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। সচরাচর জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। ফলভরা গাছ, বনের খোলা জায়গা ও চাষ করা জমিতে হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন ধরনের বীজ, শস্যদানা, কচি পাতা, কুঁড়ি ও রসালো ফল খায়। ডালপালার ভেতরে ধীরে উড়লেও বনের বাইরে দ্রুত উড়তে সক্ষম। পায়রা গভীর সুরে ‘ক্রু-উউম...’ বা ‘উ-ভা...’ শব্দে ডাকে।
মার্চ থেকে জুলাই প্রজননকাল। এ সময় ভূমি থেকে ২ থেকে ৮ মিটার উঁচুতে গাছের দোডালা বা তেডালায় পাতা ও কাঠিকুটি দিয়ে মাচার মতো ঢিলেঢালা বাসা তৈরি করে। ডিম পাড়ে দুটি, রং পীতাভ। স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই পালাক্রমে ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ১৪ থেকে ১৬ দিনে। অন্যান্য ঘুঘুর মতো মা–বাবা উভয়েই গলার থলিতে উৎপন্ন দুধ খাইয়ে ছানাদের বড় করে তোলে। ছানারা ১৫ দিন বয়সে উড়তে শেখে ও ৩৫ দিনে স্বাবলম্বী হয়। আয়ুষ্কাল পাঁচ বছরের বেশি।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ