আবার হেমন্ত এল এই বাংলায়
শরতের পায়ে পায়ে আবার হেমন্ত এল এই বাংলায়। আজ পয়লা কার্তিক। কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস নিয়ে হেমন্তকাল, বাংলা পঞ্জিকাবর্ষের চতুর্থ ঋতু। পাতা ঝরার বার্তা নিয়ে শীতকাল আসবে এর পরেই।
প্রকৃতিতে হেমন্তের আগমন টের পাওয়া যাচ্ছিল কদিন ধরেই। ধানের সবুজ পাতায় শিশিরবিন্দুর চুম্বন, চোখের সামনে ভরা আকাশ, দিনের আয়ু ছোট হয়ে আসা, দিনান্তে কুয়াশার পটভূমিতে সূর্যের অস্ত যাওয়া; আর সন্ধ্যা নামতেই শীত শীত অনুভূতি। তাই পঞ্জিকামতে আজ হেমন্তের প্রথম দিন হলেও ঋতুটি কদিন আগেই এসে গেছে বলা যায়; আর শরতের শেষ দিনগুলোর সঙ্গে হেমন্তের প্রথম দিনগুলোর সখ্য তো আছেই।
দেশের উত্তরের জনপদে যেন শুরু হয়ে গেছে শীতের দিন। সন্ধ্যার পর থেকেই আকাশ মেঘলা হওয়ার পাশাপাশি রাতভর ঝরছে হালকা কুয়াশা। সেই কুয়াশা থাকছে সকাল আটটা অবধি। তাপমাত্রা নেমে এসেছে ২৩-২৪ ডিগ্রিতে। এর মধ্যেই শ্রমজীবী মানুষেরা ছুটছেন কাজের খোঁজে। ঘন কুয়াশার আবহে ভোরে সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলছে সম্মুখের বাতি জ্বালিয়ে।
হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিক একসময় বাংলার জনপদে আসত অভাবের বার্তা নিয়ে। এ জন্য ‘মঙ্গা’ নামক শব্দটির ঠাঁই হয়েছে অভিধানে। আমন ধান কাটা শুরু হয় মূলত কার্তিকের শেষে, অনেকটা অগ্রহায়ণজুড়ে। এই মাসে শাকসবজি-তরিতরকারি উৎপাদনের ঘাটতি চোখে পড়ে। এবার ঘাটতি আরও বেশি। অসময়ে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে আসা ঢলের পানিতে সৃষ্ট প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ফসলহানি এর অন্যতম কারণ। একটি-দুটি ছাড়া বাজারে সব রকমের সবজির অগ্নিমূল্যের রাজত্ব চলছে যেন। বাধ্য হয়ে অতি সম্প্রতি সরকার বাহাদুর কিছু সবজি খোলাবাজারে সাশ্রয়ী দামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অগ্রহায়ণ ফসল কাটার ঋতু। এ মাসে মূলত কাটা হয় আমন ধান। মাঠে মাঠে আমন ধান কাটতে থাকা কৃষকের খুশি উঠে এসেছে ‘কত গান’ কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটা লিখেছেন, ‘ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/ দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।’
ধান কাটা, এরপর মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরা, মাড়াই করা, রাত জেগে সেদ্ধ করা, উঠানের রোদে তা শুকানো, এরপর গোলায় ভরা—ঝক্কি কম নয়, তবু রয়েছে প্রাপ্তির আনন্দ।
দিন কিছুটা বদলেছে। কৃষিতে এসেছে প্রযুক্তির ব্যবহার। মেশিন দিয়ে কাটা হচ্ছে জমির ধান; পরবর্তী প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হচ্ছে যান্ত্রিক উপায়ে। তবে এ সময়ে ধান কাটার শ্রমিকের সংকটও বড় সমস্যা। দিনে ৮০০-৯০০ টাকা মজুরি দিয়েও শ্রমিক মেলে না। একবার ভাটি অঞ্চলে ধান কেটে লালমনিরহাটের পাটগ্রামে নিজ ঘরে ফিরছিলেন এক তরুণ শ্রমিক। বাস থেকে নামার পর তাঁকে রিপোর্টার জিজ্ঞেস করলেন, এবার টাকাপয়সা কেমন পেয়েছেন। তিনি উত্তর করলেন, ‘গেছিনু মফিজ হয়া, আর আসিনু হাফিজ হয়া।’ অর্থাৎ তিনি গিয়েছিলেন বাসের ছাদে চড়ে দরিদ্রবেশে, আর ফিরে এসেছেন সিটে বসে ট্যাঁকে কড়কড়ে নোট গুঁজে।
আদতে হেমন্ত রোমান্টিক ঋতু। মনোরম আকাশ, শীতল বাতাস, মাঠে মাঠে সোনার ফসল। আবার পানি কমতে থাকা খালে-বিলে ধরা পড়ে কই, শিং, মাগুর, শোল ও টাকির মতো দেশি মাছ। যদিও দুর্মূল্যের কারণে তা সাধারণের পাতে ওঠার জো নেই।
এটা ভ্রমণেরও মাস। ডিসেম্বর মাসে স্কুলে পরীক্ষা শুরুর আগে এই মধ্য অক্টোবরে অনেকেই দুই বা তিন দিনের জন্য বিহারে বের হন। এবারও হয়েছেন অনেকে। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কারণে পাহাড়ি জনপদে যাওয়া আপাতত নিষেধ। তাই চায়ের দেশ সিলেট আর সাগরকন্যা কুয়াকাটা ও কক্সবাজারকে এখন করতে হচ্ছে প্রধান গন্তব্য। তবে নভেম্বর থেকে বিধিনিষেধের বেড়াজাল উঠে যাবে—এমন আশা আমরা করব।
রাজধানীর বাসিন্দারা অনেকেই জানেন না, গ্রামীণ জনপদে এখনো হেমন্ত আসে চিরচেনা রূপেই। শেষ বিকেলে খেজুরগাছে গাছি ভাইয়ের কলস বাঁধতে যাওয়া, সুবহে সাদিকের পরপরই ঠান্ডা রস নামিয়ে আনা, এ তো শুরু হয়ে যায় অগ্রহায়ণ থেকেই। কোনো কোনো বাড়িতে এখনো পাওয়া যায় ঢেঁকির শব্দ। নতুন ধান ওঠার পর পিঠা-পায়েস বানানোর যে আয়োজন শুরু হয়, তা চলে পৌষ-মাঘ অবধি। এ ছাড়া ভাইফোঁটা, কার্তিক পূর্ণিমা ও দীপাবলির মতো উৎসব তো আছেই।
হেমন্তে আমাদের এই জনপদে দূর দেশ থেকে আসে হাজারো পরিযায়ী পাখি। কিছু পাখি এখানে খায়দায়, সংসার পাতে। শীতের শেষে আবার ফিরে যায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ওদের জন্মভূমিতে। পরিযায়ী পাখিরা আমাদের হেমন্ত-শীতের মেহমান। ভালোবাসার সওগাত নিয়ে ওরা আসে।
হেমন্ত প্রকৃতির মতোই শান্ত হোক আমাদের জনপদ। হেমন্তের রোদের মতোই হেসে উঠুক বাংলাদেশ।