আমাদের দুই চিত্রা ইগল

ঢাকার কেরানীগঞ্জে পিলারের ওপর বসা অবস্থায় ছোট চিত্রা ইগলছবি: লেখক

দুই দিনের দুই গল্প। তবে গল্পের স্থান-কাল ভিন্ন হলেও পাত্রদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

প্রথম গল্পের স্থান আমার গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার পুরান বাউশিয়া। ২৮ বছর আগের এক সকালে ক্যামেরা হাতে বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরের ময়নাকান্দির গাঙে (মেঘনার শাখা নদী) ঘুরছিলাম।

গাঙপাড়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে নৌকায় উঠলাম জলচর পাখিদের ছবি তোলার জন্য। পানিতে কিছু বদরকৈতর ও দরিয়ার চিল ভেসে বেড়াচ্ছিল। কেউ একজন গাঙের পাড়ে মুরগির নাড়িভুঁড়ি ছুড়ে ফেলতেই খয়েরি রঙের বড় আকারের এক শিকারি পাখি দর্শনীয় ভঙ্গিতে ছোঁ মেরে তা পায়ের নখে গেঁথে ফেলল। একমুহূর্ত দেরি না করে ক্যামেরার ক্যানভাসে এই ছবি আঁকলাম। প্রিন্ট করার পর দেখলাম ছবি ঠিকই আছে, কিন্তু মেলে ধরা ডানার খানিকটা কেঁপে গেছে।

সেই সময়ের পুরোনো ধীরগতির ক্যামেরা দিয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করিনি। তবে ছবির মান যেমনই হোক না কেন, বহুবার তা বিভিন্ন প্রকাশনায় ছাপা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে দেশ-বিদেশে বহুবার পাখিটিকে দেখেছি। সর্বশেষ ওর সঙ্গে দেখা হলো মৌলভীবাজারের কুরমা পক্ষী অভয়াশ্রমে ২০২২ সালে।

দ্বিতীয় গল্পটি ২০১৭ সালের নভেম্বরের এক সকালের। পাখির খোঁজে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে এসেছি। সোয়া দুই ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে নানা প্রজাতির পাখির ছবি তুললাম। সবশেষে একটি বড় মাঠের মধ্যে দিয়ে ছবি তুলতে তুলতে ইকুরিয়ার দিকে যাচ্ছিলাম। মাঠভর্তি ঘাস ও নলখাগড়া। মাঝেমধ্যে কিছু জলাধার। মাঠের মধ্যে অনেকগুলো পিলার ছিল। ঘাসের ডগায় বসা ধানটুনির ছবি

তুলে সামনের দিকে এগোতেই দেখি একটি পিলারের ওপর বড়সড় এক শিকারি পাখি বসে আছে। দ্রুত ওর সাক্ষী ছবি নিলাম। এরপর ধীরে ধীরে সামনে এগোতে থাকলাম। দু–তিনটি ছবি তুলি আর একটু এগোই। আর এভাবেই একসময় পাখিটি উড়াল দিল। আর দিয়ে গেল কিছু উড়ন্ত ছবি। পাখিটিকে প্রথম দেখেছিলাম ২০১০ সালের ১ নভেম্বর আমার কর্মস্থল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

ফেনীর মুহুরি সেচ প্রকল্প এলাকায় উড়ন্ত বড় চিত্রা ইগল
ছবি: লেখক

ওপরের দুটি গল্পের প্রথমটির পাত্র এ দেশের এক বিরল পরিযায়ী পাখি বড় চিত্রা ইগল। বড় দারোগা ইগল বা দস্যুবাজ নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে গুটিমার। বর্তমানে পাখিটি দেশে ও বিশ্বে শঙ্কাগ্রস্ত বলে বিবেচিত। ইংরেজি নাম গ্রেটার স্পটেড বা স্পটেড ইগল। গোত্র অ্যাক্সিপিট্রিডি, বৈজ্ঞানিক নাম Clanga clanga। রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপ, কাজাখস্তান, চীন ও মঙ্গোলিয়ার আবাসিক পাখিটি শীতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং মধ্য ইউরোপে পরিযায়ী হয়। পাখিটির দেহের দৈর্ঘ্য ৫৯ থেকে ৭১ সেন্টিমিটার। পুরুষের ওজন ১.৫ থেকে ১.৯ কেজি ও স্ত্রীর ১.৮ থেকে ২.৫ কেজি। একনজরে দেহের রং কালচে-বাদামি।

দ্বিতীয় গল্পের পাখিটি এ দেশের এক বিরল ও বিপন্ন আবাসিক পাখি ছোট চিত্রা বা দারোগা ইগল। পশ্চিমবঙ্গে এটিও গুটিমার নামেই পরিচিত। ইংরেজি নাম ইন্ডিয়ান স্পটেড ইগল। বৈজ্ঞানিক নাম Clanga hastata। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বহু দেশে দেখা যায়। দেহের দৈর্ঘ্য ৬০ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১.৩ থেকে ১.৯ কেজি। পালকের রং কালচে-বাদামি, তবে ঋতুভেদে তা ঘন চকলেট-কালো হতে পারে। উভয় প্রজাতির স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। আকার ছাড়াও ছোটটির চেয়ে বড় চিত্রা ইগলের ডানা বেশি চওড়া ও বর্ণ বেশি গাঢ়।

বড় চিত্রা ইগল সুন্দরবনসহ দেশের হাওর-বিল-নদী-হ্রদ-জলাভূমিতে এবং ছোটটি উন্মুক্ত বন, বনের প্রান্ত, আবাদি জমি, বড় জলাভূমির ধারে একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। দুটিতেই গাছের ডালে বসে বা বৃত্তাকারে উড়ে উড়ে খাদ্যের সন্ধান করে। বড়টির মূল খাদ্য ব্যাঙ, মাছ ও জলচর পাখি এবং ছোটটির ইঁদুর, তক্ষক, ব্যাঙ, ছোট সাপ, মাছ ইত্যাদি। বড়টি মাঝেমধ্যে ‘কিয়াক-কিয়াক-কিয়াক—-’ ও ছোটটি তীক্ষ্ণ¥কণ্ঠে ‘প্যাক-প্যাক-প্যাক—-’ শব্দে ডাকে।

এপ্রিল থেকে জুন প্রজননকাল। এ সময় স্ত্রী-পুরুষ মিলে আবাস এলাকার পানির ধারে উঁচু গাছের মাথায়, পাহাড়ের গায়ে বা মাটির ওপর ডালপালা ও পাতা দিয়ে মাচার মতো বড় বাসা বানায়। ডিম পাড়ে এক থেকে তিনটি। স্ত্রী একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ৪২ থেকে ৪৪ দিনে। ছানারা ৬৫ থেকে ৭০ দিনে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল ১৬ থেকে ১৭ বছর।

লেখক: পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ