করবী নয়, কলকে ফুল

লাল কলকে, সম্প্রতি রাজধানীর বলধা গার্ডেনে
ছবি: লেখক

স্কুলে পড়ার সময় কড়ির মতো শক্ত যে গুটি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে পাঁচঘুঁটি খেলেছি, তখন জানতামই না সেটা কোন গাছের ফল। আরও জানা ছিল না এই ফলের খোসা বা বাকলের নির্যাস কতটা বিষাক্ত! সেসব ভাবার বয়স হয়নি তখনো। তা ছাড়া ফলটি দেখতেও বেশ কারুকার্যময়।

এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছি। একদিন প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে এক বন্ধুর বাড়ি গেলাম কিছু বই ধার করতে। তাদের বাড়ির সামনেই দেখলাম একটি গাছে থোকায় থোকায় সেই ফল ঝুলছে। মাইকের মতো হলুদ রঙের অসংখ্য ফুল আর শৈল্পিক বিন্যাসের পাতা দেখে প্রথম দর্শনেই গাছটি ভালো লেগে গেল।

সাদা কলকে, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়
ছবি: লেখক

অবাক হই, সুদূর পেরুর এই গাছ সৌন্দর্যগুণে কত দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে! শুধু আমিই নয়, প্রাণ-প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশও এ ফুলের সৌন্দর্যে মজেছেন। তিনি লিখেছেন—

‘ঘাসের আঁচলে ফড়িঙের মতো আমি বেড়ায়েছি/ দেখেছি কিশোরী এসে হলুদ করবী ছিঁড়ে নেয়/ বুকে তার লাল পেড়ে ভিজে শাড়ি করুণ শঙ্খের মতো ছবি ফুটাতেছে।’

কবির উদ্ধৃত ‘হলুদ করবী’ উদ্ভিদবিজ্ঞানের বিচারে মূলত কলকে ফুল। কারণ, আমাদের দেশে করবী বা রক্তকরবীর কোনো হলুদ রকমফের নেই। কলকে ফুলকে ভুলবশত করবী নামে ডাকা হয়। অনেকেই করবী আর কলকে ফুলের মধ্যে তফাত না বুঝে এ ভুলটি করেন। সেই সূত্রে বিষয়টি স্পষ্ট যে জীবনানন্দ দাশ এখানে করবী নয়, বরং কলকে ফুলের কথাই বলেছেন। রূপসী বাংলা কাব্যে আরও অন্তত তিনবার তিনি এই ফুলের কথা বলেছেন। শুধু জীবনানন্দ দাশই নন, মধ্যযুগের বাঙালি কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীও (কবিকঙ্কণ) এ ফুলের কথা তাঁর কবিতায় উপজীব্য করেছেন—

‘তুলে পুষ্প কুরুবক কুন্দ আর কুরুন্ডক

কন্দম্ব কনক করবীর।’

অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা তাঁর শ্যামলী নিসর্গ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ফুলসংখ্যা সীমিত বিধায় পাতার সবুজে প্রস্ফুটনের ঔজ্জ্বল্য প্রচ্ছন্ন থাকে। প্রান্তিক মঞ্জরির স্বল্পজীবী সীমিতসংখ্যক ফুলগুলোকে খুবই নির্জীব দেখায়। তবু ঘন সবুজ পাতার পটভূমিতে হলুদ, সাদা কিংবা রক্তিম ফুলভরা কলকে অবশ্যই শ্রীময়।’

আমাদের দেশে তিন রঙের কলকে ফুল (Thevetia Peruviana) দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে হলুদ রঙের ফুল। ঢাকার প্রায় সব পার্ক ও উদ্যান, পরিত্যক্ত স্থান এবং পথপাশে হলুদ রঙের ফুল বেশি দেখা যায়। সে তুলনায় সাদা ও ইট-লাল রঙের ফুল দুষ্প্রাপ্য। তিন রঙের ফুল নিয়ে সুদৃশ্য কোনো বীথিও নেই কোথাও। অথচ এমন একটি পরিকল্পিত নান্দনিক বীথি অনায়াসেই তৈরি করা যায়।

কলকেগাছ পত্রবহুল, শাখা-প্রশাখা নমনীয় এবং শীর্ষ ছত্রাকৃতির। পত্র ঘন-সবুজ, সরু ছুরির ফলার মতো তীক্ষ্ণ-রৈখিক, সর্পিলভাবে ঘনবিন্যস্ত। কলকিগোত্রীয় অন্য গাছপালার মতো এদেরও সারা দেহ দুধকষপূর্ণ। পাতা, কাণ্ড, মূল, ফল—যেখানেই আঁচড় লাগুক, সেখান থেকেই কষ উত্সারিত হয়। গাছের কাণ্ড নাতিদীর্ঘ, মসৃণ, সাদাটে ধূসর।

চিরহরিৎ এ গাছ অজস্র দীর্ঘ-রৈখিক পাতার ঘনবিন্যাসে এলায়িত, ছায়ানিবিড় ও সুশ্রী। কলকে নামটি ফুলের আকৃতির জন্যই। ফুলের নিচের অংশ সরু, নলাকৃতি, প্রায় সবুজ এবং মৌগ্রন্থিধর। ফুল সুগন্ধি। পাপড়ি সংখ্যা ৫টি, মাইকের মতো। ফল সজোড়, প্রায় ডিম্বাকৃতি, দ্বিবীজীয়, পক্ব অবস্থায় ম্লান-হলুদ। বীজ কঠিন, বাদামি। ফুল ফোটে প্রায় সারা বছর।

গাছটির দুধকষ ও বীজ বিষাক্ত। এ কারণে গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহারে সতর্কতা জরুরি।