দেয়ালজুড়ে সবুজের গালিচা
পাশাপাশি কয়েকটি বহুতল ভবন। কিন্তু অন্য সব ভবনের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই আলাদা করে চোখে পড়ার মতো। ভবনের দেয়ালজুড়ে সবুজ লেপটে রয়েছে। ইট-পাথর আঁকড়ে রয়েছে লতানো গাছের সবুজ গালিচা। নান্দনিক ছোঁয়া ফুটে উঠেছে দেয়ালজুড়ে। ভবনের সামনে দাঁড়ালে মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে।
রংপুর নগরের জেল রোডে গেলে দেখা পাওয়া যাবে সবুজ আচ্ছাদিত এসব ভবন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপরীতে তাকালেই চোখ আটকে যাবে দেয়ালজোড়া সবুজে। ভবনের গায়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় আলাদা করে লেখা রয়েছে ‘আরডিআরএস বাংলাদেশ’। বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস বাংলাদেশের কার্যালয় ও অতিথিশালা এটি।
মূল ফটক দিয়ে পূর্ব দিকে যত দূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। কংক্রিটের ঢালাই করা সড়ক। শুরুতে উঁচু দুটি কলাপতিগাছ স্বাগত জানাল। সড়কের দুই পাশে সারি সারি দেবদারু, পাতাবাহার আর রংবেরঙের ফুলের গাছ। ফুটেছে হলুদ অলকানন্দা। প্রতিষ্ঠানটির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফলকে একটি বাণী লেখা—উদ্ভাবনে, অংশীদারিত্বে, অভিযোজনে উন্নয়নের পথে, এক সাথে।
প্রশাসনিক ভবনের ঠিক সামনে মাটির টেরাকোটা শোভা বাড়িয়েছে। বরেণ্য টেরাকোটাশিল্পী অলোক রায়ের হাতের ছোঁয়া রয়েছে এতে। বানানো হয়েছে ১৯৯৯ সালে। ওই বছরের শেষ কিংবা ২০০০ সালের শুরুর দিকে এ ভবনগুলোর দেয়ালে সবুজ লতা লাগানো শুরু হয়। এরপর দিন-মাস-বছর পেরিয়েছে, বড় হয়েছে সবুজের গালিচা।
সবুজ ভবনের মাঝে কাচের জানালাগুলো দেখতে অনেকটা ছোট কুঠুরির মতো লাগে। জানালার ফাঁকে ফাঁকে কিছুটা ইটের গাঁথুনিও চোখে পড়ে। লতানো গাছের কারণে ভবন সব সময় ঠান্ডা থাকে। গরমের মৌসুমে এসির খরচ কম হয়। দেখতে সুন্দর লাগে। ছয় মাস পরপর ভবনের লতা ছেঁটে দিতে হয়।
দেয়াল বেয়ে বেড়ে ওঠা লতানো গাছের নাম ‘ওয়ালক্রিপার’। এটি লতাডুমুর বা দেয়ালডুমুর নামেও পরিচিত। কেউবা লতাবট নামেও ডাকেন। বৈজ্ঞানিক নাম Ficus pumila। এটি বহুবর্ষজীবী অধিক শাখান্বিত লতানো গাছ। শোভাবর্ধক হিসেবে লাগানো হয়।
ওয়ালক্রিপার ছাড়াও এই ক্যাম্পাসে রয়েছে গোলাপ, জবা, পর্তুলিকাসহ নানা ফুলের গাছ। রয়েছে পেঁপে, পেয়ারা, গাব, লিচু, কাঁঠাল, আম, আমড়া, নারকেল, লটকন ফলের গাছ। রয়েছে অর্জুন, আমলকীর মতো ঔষধি গাছ। বর্ণিল পাতাবাহার, কাঁটামেহেদি, ঝাউঝোপের পাশাপাশি চোখ জুড়িয়ে যায় ছোট-বড় আর্কেডিয়া ও ক্রিসমাস ট্রি দেখে। সবুজ গাছে ঘেরা শানবাঁধানো পুকুরপাড় রয়েছে। আরও রয়েছে শিশুদের বিনোদন উদ্যান।
আরডিআরএস বাংলাদেশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশনস সমন্বয়ক আশাফা সেলিমের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানান, পুরো ক্যাম্পাস পরিবেশবান্ধব। প্রাকৃতিকভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়। নিয়মিত পরিচর্যার কারণে দেয়াল বেয়ে ওঠা ওয়ালক্রিপারসহ বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের নাম জড়িয়ে রয়েছে। ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের সহায়তা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তখন এর নাম ছিল কোচবিহার রিফিউজি সার্ভিস (সিবিআরএস)। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে রংপুর-দিনাজপুর রুরাল সার্ভিসের (আরডিআরএস) যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এটি একটি আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। বর্তমানে এই সংস্থার নাম আরডিআরএস বাংলাদেশ।
রংপুরে প্রশাসনিক ভবনের সামনে মার্বেল পাথরের একটি নামফলক চোখে পড়বে। তাতে লেখা ওলাভ হুডনির নাম। নরওয়ের নাগরিক হুডনি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই থেকে আরডিআরএস বাংলাদেশ জাতীয় উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির এখনকার নির্বাহী পরিচালক তপন কুমার কর্মকার।
রংপুর ক্যাম্পাসের আয়তন ২ দশমিক ২৫ একর। এখানে রয়েছে দুটি আধুনিক অতিথিশালা। আরও রয়েছে বেগম রোকেয়া মিলনায়তন, একাধিক সেমিনারকক্ষ। একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ও ‘মুজিব কর্নার’ রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মশালা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এখানে।
সম্প্রতি এখানে অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালায় অংশ নেন কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী সুনন্দা সরকার। তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির সবকিছুই সুন্দর। মন ভালো হয়ে যায় এখানে এলে।’
এই অনুভূতি সুনন্দার একার নয়, যাঁরা এখানে কোনো না কোনো কাজে এসেছেন, সবাই ফিরেছেন এমন সুখানুভূতি নিয়ে।