পয়েনসেটিয়ার জাতের বাহার 

ঢাকার আগারগাঁওয়ে ফ্যালকন নার্সারিতে পয়েনসেটিয়াছবি: লেখক

ক্রিসমাস এলেই মনে পড়ে পয়েনসেটিয়াকে। কেন মনে পড়ে, সে এক মজার কাহিনি। পয়েনসেটিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা দেশের কিংবদন্তি ও পৌরাণিক কাহিনি। ক্রিসমাসের সময়, অর্থাৎ ডিসেম্বরেই পয়েনসেটিয়া রঙে রঙে পত্রপল্লবে সেজে ওঠে। ক্রিসমাস আর পয়েনসেটিয়া যেন হাত ধরাধরি করে আসে। মেক্সিকানদের মধ্যে এ নিয়ে একটা পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। সে দেশে একসময় পেপিতা নামের এক গরিব বালিকা ছিল। ক্রিসমাসে উপাসনাকক্ষে গিয়ে ঈশ্বর যিশুকে উপহার দেওয়ার মতো কিছুই তার ছিল না। তবু সে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে উপাসনাকক্ষের কাছে গেল ও মন খারাপ করে কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। তার চাচাতো ভাই পেড্রো তাকে এভাবে বিষণ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কারণ জানতে চাইল। জানার পর পেড্রো বলল, ‘মন খারাপ কোরো না বোন, আমি নিশ্চিত যে তুমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে যে উপহারই দেবে, সেটা যত ক্ষুদ্রই হোক, দেখবে তাতেই যিশু খুশি হবেন।’

এ কথা শোনার পর পেপিতা দৌড়ে রাস্তায় ছুটে গেল। কী দেওয়া যায়? কিছুই পেল না সে। অবশেষে রাস্তার পাশ থেকে কিছু আগাছার ডগা তুলে সেগুলো দিয়ে একটা তোড়া বানিয়ে ফিরে গেল উপাসনাকক্ষে। কক্ষের ভেতরে বেদির ওপর সেই তোড়া রাখল। চোখ মুদে ভক্তি ও ভালোবাসা দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে সে যিশুর উদ্দেশে নিবেদন করল তার সেই অর্ঘ্য। হঠাৎ সেই তোড়া টকটকে লাল ফুলে পরিণত হয়ে ফেটে পড়ল। সবাই সেই আশ্চর্যজনক ঘটনা দেখল ও বিশ্বাস করতে শুরু করল, লাল ফুলই সে রাতের পবিত্র ফুল। 

কখনো কখনো পয়েনসেটিয়ার ফুল ও পাতাগুলোকে আকাশের তারার মতো মনে হয়। সেটিকেও বিশ্বাস করা হয় বেথলেহেমের তারা রূপে যা হলো যিশুর জ্ঞানের প্রতীক আর লাল পাতাগুলো হলো তার রক্তের প্রতীক। সাদাটে পাতা হলো বিশুদ্ধতার প্রতীক। মেক্সিকোয় এখনো পয়েনসেটিয়া উৎসবের রং, সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির প্রতীক। মেক্সিকো ও গুয়াতেমালায় পয়েনসেটিয়াকে ডাকা হয় ‘ক্রিসমাস ইভ ফ্লাওয়ার’ নামে।

গত বছরও ক্রিসমাস ডে ঘিরে এ গাছকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। সে বছর পয়েনসেটিয়ার দেশি টকটকে লাল জাতটাই ছিল চোখের সামনে, যার বাংলা নাম পত্রমঞ্জরি। আর একটা জাত দেখেছিলাম সাভারে বরিশাল নার্সারিতে, যেটার রং ছিল গোলাপি। সাদা ও হলদে পাতার পয়েনসেটিয়া কখনো দেখা হয়নি। মাত্র এক বছরের ব্যবধান, অথচ এর মধ্যেই এ দেশে এখন বেশ কয়েক জাতের পয়েনসেটিয়া দেখা যাচ্ছে। শীতের ভোরে কুয়াশা আর মেঘলা আকাশকে সাথি করে আগারগাঁওয়ে ত্রিকোণাকার ইগল সড়কদ্বীপে ফ্যালকন নার্সারিতে গিয়ে দেখা পেলাম ৯ জাতের পয়েনসেটিয়ার। সেখানকার মালিরা বললেন, এবার থাইল্যান্ড থেকে আনা হয়েছে নতুন আটটি জাত। একটা জাতের পয়েনসেটিয়াগাছের ডগার পাতার রং দেখলাম সাদা, নিচের পাতাগুলো সবুজ। কোনোটার ডগার পাতা গোলাপি, একটার রং লালচে সবুজ। আবার একটার পাতা হলদে ফুটি দাগযুক্ত খয়রা লাল। আবার একটার পাতা গোলাপি ঠিকই কিন্তু মাঝশিরার দুপাশে ছড়ানো হলদে আভা। 

পয়েনসেটিয়া নরম কাণ্ডের গুল্ম স্বভাবের বহুবর্ষজীবী গাছ, গাছ বড়জোর ২ থেকে ৩ মিটার লম্বা হয়। তবে এখন হাইব্রিড জাতের বেশ কিছু খাটো গাছ এসেছে এ দেশে, যেগুলো টবে বেশ ভালোভাবে লাগানো ও রাখা যায়। ডালে পাতাগুলো একটার মুখে আর একটা জন্মে। পাতার আগা সরু ও সূচালো। পাতা ও ডাল ভাঙলে সাদা দুধের মতো কষ ঝরে। ইউফরবিয়েসি গোত্রের এ গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Euphorbia pulcherrima. আঠারো শতকের বিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী জোয়েল রবার্টস পয়েনসেটের নামানুসারে এ গাছের নাম রাখা হয় পয়েনসেটিয়া। মন্ত্রী হলেও তিনি ছিলেন একজন উদ্ভিদবিদ। তাঁর নামের গাছটাই এখন যেন বিশ্বব্যাপী হয়ে উঠেছে ক্রিসমাস ডের এক অন্যতম উপহার ও গৃহসজ্জার সামগ্রী। এ দেশে পয়েনসেটিয়ার চাষ সহজে করা যায়, গাছও সুলভ। যেকোনো বাগানে ও বাড়িতে টবে পয়েনসেটিয়া লাগানো যায়।