সকাল সকাল পাহাড়ি ঝিরি ধরে হাঁটছি। সামনে আছে শ্রীমঙ্গলের বন্য প্রাণী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেঞ্জারড ওয়াইল্ডলাইফের খোকন থৌনাজম ও সোহেল শ্যাম। সঙ্গে হাঁটছেন স্থানীয় তরুণ খোরশেদ আলম।
বনের লাগোয়া গ্রাম থেকে বেরিয়ে দুই কদম হাঁটতেই ঝিরির নরম সোনালি বালুতে টাটকা পায়ের ছাপ নজরে এল। এটি ছোট ভোঁদড়ের পায়ের ছাপ। বিশ্বব্যাপী বিপদাপন্ন এই ছোট মাংসাশী স্তন্যপায়ী প্রাণীটি ভোরবেলাতেই এই ঝিরি ধরে সদলবলে গেছে। মানুষের আস্তানার এত কাছে ভোঁদড়ের উপস্থিতি দেখে যারপরনাই খুশি হলাম। সবাইকে ডেকে দেখালাম। পরে সারা দিন ধরে আমরা বনের নানা অংশে ভোঁদড়ের চিহ্ন পেলাম। কোথাও তাদের পায়ের ছাপ, কোথাও তাদের খাওয়া মাছ আর কাঁকড়ার অংশবিশেষ। কোথাও তারা বালুতে খেলা করেছে। ভোঁদড়ের রাজ্যে আমরা হাঁটছি—এই ভাবনা আমাদের পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিল। এই বনে সেটিই প্রথম ভোঁদড়ের উপস্থিতির প্রমাণ, যা আইইউসিএনের জার্নালে ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়।
যে বনের কথা বলছি, তার নাম লাঠিটিলা। ২০২১–এর বর্ষায় আমরা গিয়েছিলাম বনটির অবস্থা সরেজমিন দেখতে। ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার আর জুড়ী উপজেলা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া দুর্গম এই বনে তখন সাফারি পার্কের নামে একটি বড়সড় চিড়িয়াখানা স্থাপনের সরকারি তোড়জোড় চলছিল। পুরো ভাবনাই প্রকৃতিপ্রেমীদের ভীষণ ব্যথিত করেছিল। তার থেকেও আমাদের অবাক করেছিল এই তোড়জোড়ের আগে মাত্র দুই মাসের মধ্যে আর মাত্র ১০টি ক্যামেরা-ট্র্যাপ দিয়ে শেষ করা জীববৈচিত্র্য সমীক্ষাটি। প্রকৃতিপ্রেমী নানা সংগঠন তাই শত বাধা উপেক্ষা করে নিজ চোখে লাঠিটিলা বনকে দেখার আর জানার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এত দুর্গম বনে যে পৃথিবীর কোথাও কোনো চিড়িয়াখানা স্থাপনের নজির নেই।
কী নেই লাঠিটিলা বনে! ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের অংশ ৮০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত পাথারিয়া বনের দক্ষিণে ২২ বর্গকিলোমিটার হচ্ছে লাঠিটিলা বন।
এই বনে বিশ্বব্যাপী হুমকির মুখে থাকা অসংখ্য বন্য প্রাণীর আবাস। ভোঁদড় ছাড়াও এই বনে বাস করে রাজগোখরা, হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ, বাংলা শকুন, ছোট মদনটাক, বনরুই, খরগোশ, তুলিলেজি শজারু, চশমাপরা হনুমান, মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর, বিন্টুরং আর বড় উড়ন্ত কাঠবিড়ালি। দেশের বইগুলোতে এই বনে ভালুক, মর্মর বিড়াল, ল্যামচিতা আর চিতা বাঘের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে। ২০২৩ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামেরা-ট্র্যাপ সমীক্ষায় মেছো বিড়াল এবং সোনালি বিড়ালের কথাও একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। একই সময়ে আমার করা ক্যামেরা-ট্র্যাপ গবেষণায় সিলেট বিভাগে প্রথমবারের মতো কাঠময়ূরের প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি এই অঞ্চলে একমাত্র এই বনেই বুনো হাতির দেখা মেলে।
সাফারি আর সাফারি পার্ক এক নয়। আফ্রিকার উন্মুক্ত প্রান্তরে বা ভারত-নেপালের খোলা ঘাসবনে চরে বেড়ানো প্রাণীদের গাড়িতে চড়ে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে দেখার নাম সাফারি। এসব বনের বিশাল বিস্তৃতি। আর সাফারি পার্ক হচ্ছে চিড়িয়াখানার আধুনিক রূপ। লাঠিটিলায় সাফারি পার্কের পরিকল্পনা করা হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাফারি পার্কের আদলে। যেগুলোর সবই লোকালয়ের ভেতরে। বৈজ্ঞানিকভাবে পরিচালনা করার পরও এসব পার্কের নামে রয়েছে নানা বিতর্ক। লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক স্থাপনের প্রাথমিক পরিকল্পনায় ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১৪ মিলিয়ন ডলার। বলা হয়েছিল নানা ধরনের আফ্রিকান প্রাণী, খাঁচার পাখি, সিংহ, হায়েনা আর চিতা আনার কথা। এমনকি এই দুর্গম বনে ডলফিন আনার কথাও বলা হয়েছিল।
বিদেশি এত প্রাণী আনা হলে আমাদের দেশীয় বন্য প্রাণী অপরিচিত নানা পরজীবী দ্বারাও আক্রান্ত হতে পারে। দেশের চিড়িয়াখানাগুলোতে প্রায়ই অ্যানথ্রাক্সে নানা প্রাণী মরার খবর শুনি। আর দেশের একটি চিড়িয়াখানারও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। এত সব অসংগতির বিষয়ে দেশের ১৭ জন প্রাণী–গবেষকের মতামত আন্তর্জাতিক জার্নাল কনজারভেশন–এ ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে এই পরিকল্পনায় নানা পরিমার্জন আনা হয়। তার পরও এত দুর্গম এলাকায় এই স্থাপনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আমাদের দেশে পাহাড়ি বনে গবেষণা-সংরক্ষণ কার্যক্রম নিতান্তই অপ্রতুল। যেসব পাহাড়ি সংরক্ষিত এলাকা আছে, সেগুলোর আয়তন অত্যন্ত ছোট, যা উপকারের থেকে ক্ষতিই বেশি করে। সংরক্ষিত এলাকার বাইরে অবাধ ধ্বংসযজ্ঞ চলে, যা ধীরে ধীরে সংরক্ষিত এলাকাটিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। প্রাণীরাও বিলুপ্ত হয়ে যায়। ২০১০ সালের পর বড় পরিসরে পাহাড়ি বনগুলোকে সংরক্ষিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ লাঠিটিলা, কাসালং, রাজকান্দির মতো এখনো অত্যন্ত সমৃদ্ধ কিছু বন এসব উদ্যোগের যোগ্য দাবিদার।
আমরা কিছুদিন আগেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দূষণমুক্ত নদী দেখানোর প্রতিজ্ঞা করেছি। আমরা তাদের একটি প্রকৃত পাহাড়ি বন দেখানোর প্রতিজ্ঞাও নিতে পারি। শতসহস্র বছর টিকে থাকুক লাঠিটিলা বন।
মুনতাসির আকাশ: সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়