অবশেষে সকাল গড়াতেই রাজধানীতে রোদের দেখা পাওয়া গেছে। রোববারের তুলনায় গতকাল সোমবার এক দিনের ব্যবধানে রাজধানীর দিনের তাপমাত্রা বেড়েছে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে বরিশাল বিভাগে এক দিনে তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে শুরু হয়ে গেছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল বরিশালে—সাড়ে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজধানীর মতো দেশের মধ্যাঞ্চলেও উষ্ণতা কিছুটা বেড়েছে। এতে দিনে শীতের কষ্ট কিছুটা কমলেও সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে গায়ে কাঁটা দেওয়া হিমেল হাওয়ার দাপট ফিরে এসেছে।
দেশের উত্তরাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে অবশ্য পাঁচ দিন ধরে দিনভর ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতের অনুভূতি থাকছে। গতকালও রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের বেশির ভাগ এলাকায় শৈত্যপ্রবাহের কাছাকাছি তাপমাত্রা ছিল। কুয়াশা বেশি থাকায় সৈয়দপুর, রাজশাহী ও সিলেট বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামায় সমস্যা হয়েছে। ফেরি চলাচলেও বিঘ্ন ঘটেছে। আর হাসপাতালগুলোতে বেড়ে গেছে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষের ভিড়। বিশেষ করে শিশুদের কষ্ট ছিল বেশি।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, মূলত কুয়াশার কারণে দেশে তীব্র শীতের এলাকা বাড়ছে। একসময় জানুয়ারিতে দেশের উত্তরাঞ্চল ও সিলেট বিভাগে মূলত তীব্র শীতের অনুভূতি থাকত। উপকূলীয় জেলাগুলোতে শীত পড়ত কম। কারণ, সমুদ্রের কাছাকাছি এলাকায় জলীয় বাষ্প বেশি থাকে। ফলে হিমালয় পেরিয়ে আসা শীতের শুষ্ক বাতাস উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু হয়ে মধ্যাঞ্চল, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত তীব্র শীত থাকছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, তা মূলত কুয়াশার কারণে ঘটছে।
তীব্র শীতের এলাকা বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জলবায়ু গবেষক সমরেন্দ্র কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে শীত নামে মূলত হিমালয় পেরিয়ে পঞ্চগড় দিয়ে শীতল বাতাস আসার কারণে। একইভাবে সিলেটে মেঘালয় থেকে আসা শীতল বাতাস প্রবেশ করে তাপমাত্রা কমায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ১৯৯৮ সালের পর থেকে জানুয়ারি মাসে তাপমাত্রা কমে যাওয়ার পাশাপাশি কুয়াশা বেড়ে যেতে দেখছি। দক্ষিণ এশিয়ার বড় অংশজুড়ে মাসের বেশির ভাগ সময় ওই কুয়াশা দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে না গেলেও তীব্র শীতের অনুভূতি থাকছে।
সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, কুয়াশার কারণে জানুয়ারিতে দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকাজুড়ে তীব্র শীতের অনুভূতি থাকছে, যা একসময় শুধু উত্তরাঞ্চল ও সিলেটে বেশি দেখা যেত। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়ে গেছে।
কুয়াশার কারণে জানুয়ারিতে দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকাজুড়ে তীব্র শীতের অনুভূতি থাকছে, যা একসময় শুধু উত্তরাঞ্চল ও সিলেটে বেশি দেখা যেত। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়ে গেছে।সমরেন্দ্র কর্মকার, আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জলবায়ু গবেষক
‘একটা কম্বলও পাই নাই’
গতকাল রাত আটটার দিকে বরিশাল নগরের মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, স্টিমারঘাট, সিটি মার্কেট ও নদীবন্দর এলাকায় দেখা যায়, তীব্র শীত থেকে রক্ষা পেতে মানুষ রাস্তার পাশে, খোলা স্থানে আগুন জ্বালিয়ে শরীর গরম করার চেষ্টা করছেন। নদীবন্দরে ভাসমান ও ছিন্নমূল মানুষ কনকনে শীতে বন্দরের মেঝেতে আশ্রয় নিয়ে শীতে কাঁপছিলেন। তাঁদের একজন গণি মিয়া (৬৫)। তাঁর বাড়ি ছিল সদর উপজেলার চন্দ্রমোহন এলাকায়। নদীভাঙনে ভিটেবাড়ি হারিয়ে এখন তিনি ছিন্নমূল। স্ত্রী জাহানারা বেগমকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন নদীবন্দরে। গণি মিয়া বললেন, ‘শীতে খুব কষ্ট পাইতে লাগছি। একটা কম্বলও পাই নাই। ছেঁড়া-পাতলা একটা খাতা (কাঁথা) দিয়ে শীত মানে না। রাইতে ঘুমাইতে পারি না।’
খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন হায়াতখালী গ্রামের কয়রা নদীর চরে কাজ করছিলেন আমেনা বেগম। শীত কেমন, জানতে চাইলে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘শীত শুধু আমাগের গায়েই লাগে, পেটে লাগে না।’ তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে মাটির চাপ রাখতে রাখতে সাবিনা খাতুন নামের আরেক শ্রমজীবী বললেন, ‘এক দিন কাজে না বের হইলে পেট চালানো মুশকিল। নিজেরা খাই বা না খাই, ছাওয়াল-মাইয়েগের জন্যি তো দুই বেলা খাবার জোগাড় করতি হবে। শীতের কষ্ট গায়ে সইলেও পেটে সয় না।’
গতকাল দুপুরে ২৫০ শয্যার নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে শীতজনিত রোগী দেখা যায়। শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, শয্যাসংখ্যার তুলনায় রোগী বেশি। শিশুদের নেবুলাইজ করতে ব্যস্ত ছিলেন উদ্বিগ্ন মায়েরা।
এদিকে তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে নওগাঁর বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিয়েছে আলুখেতে ছত্রাকজনিত লেট ব্লাইট (নাবিধসা) রোগ। এ রোগে প্রথমে আলুগাছের পাতা ঝলসে যায়, পরে পুরো গাছ মরে যায়। একই কারণে বোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
উদ্বিগ্ন আবহাওয়াবিদেরা
চলতি মাসের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশজুড়ে শীতের কষ্ট বেড়ে যাওয়া নিয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এই প্রবণতাকে আবহাওয়ার ধরনের বদলকে ইঙ্গিত করছে বলে মনে করছেন তাঁরা। বিশেষ করে জানুয়ারির শুরু থেকে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পাকিস্তান ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের ওপর একটি ভারী কুয়াশার চাদর ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে দেশের ভেতরেও নিচু মেঘ বা লো ক্লাউড তৈরি হচ্ছে। বাতাসে ভেসে বেড়ানো ধুলা ও ধোঁয়া এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে। এ কারণেই অস্বাভাবিক কুয়াশা তৈরি হচ্ছে, যা দিনের তাপমাত্রা কমিয়ে দিচ্ছে।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, কুয়াশার দাপটের কারণে সূর্যের আলো ভূমিতে আসতে পারছে না। ফলে রোদ কম আসায় দিনেও তীব্র শীতের কষ্ট বাড়ছে। অন্যদিকে ওই ঘন নিচু মেঘের কারণে আটকে যাচ্ছে দৃষ্টিসীমা। উড়োজাহাজ থেকে শুরু করে নৌযান ও সড়কের যানবাহন চলাচলে সমস্যা বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে দিনে রোদ কম আসা ও শীতের অনুভূতি বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। মাঠে শীতকালীন ফসল ধান ও সবজির উৎপাদনেও সমস্যা বাড়াচ্ছে।
ঢাকায় শৈত্যপ্রবাহ নেই, তবে শীত বেশি
গত ৩৩ বছরে ঢাকার আবহাওয়ার গড় তাপমাত্রার রেকর্ড বলছে, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকার গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হওয়ার কথা। কিন্তু আট বছর ধরে ঢাকার গড় তাপমাত্রা বিবেচনায় নিলে তা কোনোভাবেই ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামেনি। ব্যতিক্রম ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি। ওই দিন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়। এ বছরও ঢাকায় ডিসেম্বরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা গড়ে ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল। আর জানুয়ারির প্রথম ১৫ দিনে তা প্রায় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকছে। এক সপ্তাহ ধরে ঢাকার দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকছে। ফলে তীব্র শীতে রাজধানীর জীবনযাত্রা রীতিমতো স্থবির হয়ে পড়েছে।
যদিও ঢাকায় গত আট বছরে একবার শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। এ বছর শৈত্যপ্রবাহ না হলেও তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণে তীব্র শীতের অনুভূতিই পাচ্ছেন নগরবাসী।
প্রস্তুতি দরকার
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শীতকালে কোন এলাকায় শীত বেশি, তা এখন আর শৈত্যপ্রবাহ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। কারণ, দিন ও রাতের তাপমাত্রা কমে এলে তা শৈত্যপ্রবাহের চেয়েও বেশি শীতের অনুভূতি হয়। এখন শৈত্যপ্রবাহ দেশের চার–পাঁচটি জেলায় থাকলেও তীব্র শীতের অনুভূতি দেশের দুই–তৃতীয়াংশ এলাকায় থাকছে। ফলে এ ধরনের শীত মোকাবিলায় আমাদের কৃষি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল, প্রতিনিধি, নীলফামারী, নওগাঁ ও কয়রা (খুলনা)]